বিলাসপুরে কারা–কীভাবে–কোথায় ককটেল বানান, কত টাকা পান

শরীয়তপুরের জাজিরায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দুই পক্ষ সংঘর্ষ জড়িয়ে বালতিতে করে ককটেল নিয়ে বিস্ফোরণ ঘটনায়। বিলাসপুর ইউনিয়নের দূর্বাডাঙ্গা এলাকায়ছবি: সংগৃহীত

বালতিতে করে ককটেল নিয়ে ‘খইয়ের মতো’ ফুটিয়ে সংঘাতে জড়ানো শরীয়তপুরের জাজিরার বিলাসপুর ইউনিয়নে নতুন ঘটনা নয়। এ চিত্র অন্তত ২০ বছরের। প্রতিবছর ছয় থেকে আটবার এমন ‘ককটেল সংঘাত’ হয়। ককটেলগুলো বানানো হয় বিলাসপুরের বিভিন্ন গ্রামে। ককটেল বানাতে গিয়ে বিস্ফোরণে গত ১৫ বছরে একজনের প্রাণহানি এবং ৩০ জনের অঙ্গহানি হয়েছে, এমন তথ্য স্থানীয় ব্যক্তি ও পুলিশের।

পুলিশ ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ককটেল তৈরি করা, বিস্ফোরণ ঘটিয়ে এলাকায় আতঙ্ক তৈরি করে লুটপাট করা, সংঘর্ষে জড়ানো ও হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন আওয়ামী লীগ নেতা কুদ্দুস ব্যাপারী ও জলিল মাতবর। ওই দুই পক্ষের আছে ককটেল তৈরির প্রশিক্ষিত লোক। বিলাসপুরে তৈরি করা ককটেল শুধু যে বিলাসপুরেই ব্যবহৃত হয়, এমন নয়। এসব ককটেল বিক্রি করা হয় জেলার বিভিন্ন এলাকার সন্ত্রাসীদের কাছে। জেলার যেখানেই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে, সেখানেই বিলাসপুরের ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।

বিলাসপুর ইউনিয়নের অধিকাংশ গ্রাম পদ্মা নদীর তীরবর্তী। ওই এলাকায় জেগে ওঠা চরের জমি দখলে নেওয়া, পদ্মা নদীর নৌপথ নিয়ন্ত্রণ, বালু উত্তোলন নিয়ন্ত্রণ, মাছ শিকার নিয়ন্ত্রণ, ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে জয়-পরাজয় নিয়ে বিরোধ ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সহিংসতা হয়। বিলাসপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি কুদ্দুস ব্যাপারী এবং পরাজিত চেয়ারম্যান প্রার্থী জলিল মাতবর দুটি বাহিনী গড়ে তুলেছেন। তাঁদের মদদ দেওয়ার অভিযোগ আছে সাবেক সংসদ সদস্য বি এম মোজাম্মেল হক ও ইকবাল হোসেনের বিরুদ্ধে।

ককটেল বানান পাচু খাঁরকান্দি এলাকার এমন একজনের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তিনি তাঁর নাম প্রকাশ করতে চাননি। তিনি বলেন, টাকার বিনিময়ে তিনি কুদ্দুস ব্যাপারীর লোকজনকে ককটেল তৈরি করে দেন। ওই পক্ষের লোকজন গোলাবারুদ (বিস্ফোরক) এনে দেন। সেটা দিয়ে তিনি ককটেল তৈরি করেন। একেকটি অর্ডারে কমপক্ষে ৫০টি করে ককটেল তৈরি করা হয়। এর জন্য পারিশ্রমিক পান ২০ হাজার টাকা। গ্রামের নির্জন স্থানে, বাগানে, পদ্মা নদীর চরে বা নৌকায় বসে এ কাজ করেন।

শরীয়তপুরের জাজিরায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দুই পক্ষের সংঘর্ষ। শনিবার সকালে বিলাসপুর ইউনিয়নের দূর্বাডাঙ্গা এলাকায়
ছবি: সংগৃহীত

গত ১৫ বছরে বিলাসপুরে ককটেল বিস্ফোরণে আহত ব্যক্তিদের কয়েকজন ও নিহত ব্যক্তির স্বজনদের ভাষ্য, কুদ্দুসের ভাই সিদাম ব্যাপারী ও জলিলের ভাই বিদ্যুৎ মাতবরের নেতৃত্বে অন্তত ১০টি দল ককটেল বোমা তৈরির কাজ করে। ইউনিয়নের মুলাই ব্যাপারীকান্দি, মেহের আলী মাতবরকান্দি, ইয়াছিন মাতবরকান্দি, মিয়াচান মুন্সিকান্দি, কাজিয়ারচর, পাচু খাঁরকান্দি এলাকা ও পদ্মা নদীর বিভিন্ন চরে বসে ওই দলগুলো ককটেল বোমা তৈরি করে।

২০১৪ সালের ১৯ মে কাজিয়ারচর এলাকায় ককটেল তৈরি করতে গিয়ে বিস্ফোরণে মারা যান অনিক মাতবর নামের এক তরুণ। তখন পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা করেছিল।

অনিকের বাবা মনির মাতবর এখন ঢাকায় থাকেন। মুঠোফোনে কথা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অনিক বোমা বিস্ফোরণে আহত হওয়ার পর ঢাকায় নেওয়া হয়। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। তখন পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেছিল। পরে ওই মামলার কোনো খোঁজখবর তিনি রাখেননি।

আরও পড়ুন

ককটেল বানাতে গিয়ে হাত ও পা হারিয়েছেন, এমন চারজনের সঙ্গে প্রথম আলো কথা বলেছে। তাঁরা সবাই সাম্প্রতিক সংঘাতের ঘটনায় পুলিশের করা বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় আসামি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁদের একজন বলেন, কুদ্দুসের লোকজন একসময় তাঁদের ওপর অত্যাচার করতেন। তাঁদের মোকাবিলা করার জন্য ও এলাকায় টিকে থাকার জন্য তাঁরা ককটেল তৈরির উদ্যোগ নেন। ২০১২ সালে ২০ এপ্রিল ককটেল বিস্ফোরণে তাঁর হাতের কবজি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং পায়ের মাংসে ক্ষত সৃষ্টি হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেক আহত ব্যক্তি বলেন, জেলার সন্ত্রাসী ও বিভিন্ন দলের মানুষ জানে, বিলাসপুরে কারা ককটেল বানান। তাঁরা ওই লোকজনের মাধ্যমে বিলাসপুর থেকে ককটেল সংগ্রহ করেন। নানা সংঘর্ষ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে এগুলো ব্যবহার করা হয়।

গত শনিবার ককটেল বিস্ফোরণের সর্বশেষ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে দুই পক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। ককটেল তৈরিতে নেতৃত্ব দেওয়া সিদাম ব্যাপারী ও বিদ্যুৎ মাতবর ওই মামলায় আসামি হয়ে পলাতক। আর কুদ্দুস ও জলিল কারাগারে। এ কারণে তাঁদের বক্তব্য নেওয়া যায়নি।

আরও পড়ুন

সার্বিক বিষয়ে শরীয়তপুরের পুলিশ সুপার নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশের কাছে দুই ধরনের তথ্য আছে। এক হচ্ছে, বিলাসপুরে কিছু ‘এক্সপার্ট’ আছেন, যাঁরা ককটেল বানান। তাঁরা বিবদমান দুই পক্ষের লোকজন। আবার সহিংসতা ঘটানোর জন্য বাইরে থেকেও লোক আনা হয়। বিস্ফোরণ ঘটানো ককটেল কোথায় বানানো হচ্ছে, কারা বানাচ্ছেন, এর কাঁচামাল কোথা থেকে কীভাবে আসছে, তা খোঁজার জন্য কাজ করছে পুলিশ। বিলাসপুরের সাম্প্রতিক ঘটনাটি পুলিশকে বিব্রত করেছে। ওই ঘটনায় করা মামলায় দুই পক্ষের নেতা ও তাদের সমর্থকদের আসামি করা হয়েছে। প্রধান আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশ তাঁকে রিমান্ডে নিয়েছে। তাঁর কাছ থেকে তথ্য জানার চেষ্টা করা হবে।

আরও পড়ুন