ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আট মাসে ১৫ ছোট–বড় পাহাড় কেটে মাটি বিক্রি
উপজেলার গোপীনাথপুর ও বায়েক ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় গত আট মাসে অন্তত ১৫টি ছোট-বড় পাহাড় কাটার অভিযোগ।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকায় অবৈধভাবে পাহাড় কাটা চলছে। বড় বড় পাহাড় কেটে সমতলভূমিতে পরিণত করছেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। ভারত সীমান্তঘেঁষা উপজেলার গোপীনাথপুর ও বায়েক ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় গত আট মাসে অন্তত ১৫টি ছোট-বড় পাহাড় কাটার অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রশাসন কিছু ঘটনায় মামলা ও জরিমানা করলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নীরব থাকছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই দুই ইউনিয়নে ব্যক্তিমালিকানাধীন ছোট ছোট টিলা বা পাহাড় রয়েছে। পাহাড়মালিকদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে খননযন্ত্র (ভেকু) দিয়ে পাহাড় কেটে মাটি ট্রাক্টরে নিয়ে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। কয়েক বছর ধরে গোপীনাথপুর ইউনিয়নের পাথারিয়াদ্বার, কাজীয়াটুলি (কাইজ্জামুড়ি), মাণিক্যমুড়ি ও মধুপুর এলাকার বড় বড় পাহাড় কেটে মাটি অন্যত্র নিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে ইউনিয়নে আর পাহাড় থাকবে না বলে স্থানীয় লোকজন আশঙ্কা করছেন।
এসবের সঙ্গে আমি জড়িত না। কে বলে আমার কথা, তাদের নাম বলেন। আমি সরকারি চাকরি করি, সারা দিন স্কুলে থাকি। এই ইউনিয়নে একটিই পাহাড় আছে, বাকিগুলোর শ্রেণি বাড়ি লেখা।স্কুলশিক্ষক আমজাদ হোসেন
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-এর ৬(খ) ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সরকারি বা আধা সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন বা দখলাধীন বা ব্যক্তিমালিকানাধীন পাহাড় ও টিলা কর্তন বা মোচন করতে পারবে না। তবে অপরিহার্য জাতীয় স্বার্থের প্রয়োজনে অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিয়ে পাহাড় বা টিলা কাটা যেতে পারে।
স্থানীয় লোকজন বলছেন, কসবা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. আমজাদ হোসেন ও তাঁর ভাই গোপীনাথপুর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মো. মুক্তার হোসেন, একই ইউনিয়ন পরিষদের আরেক ইউপি সদস্য মো. আবদুল মান্নান এসব পাহাড় কাটার সঙ্গে জড়িত। তাঁদের মধ্যে আমজাদ সম্পর্কে একজন মন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারীর ভগ্নিপতি। পাহাড় কাটার ঘটনায় হওয়া একটি মামলায় আবদুল মান্নান আসামি।
■ পাহাড় কাটার অভিযোগে দুই বছরে পাঁচটি মামলা হয়েছে।
■ পরিবেশ অধিদপ্তর একটি মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন এবং আরেকটিতে অভিযোগপত্র দিয়েছে।
অভিযোগের বিষয়ে স্কুলশিক্ষক আমজাদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এসবের সঙ্গে আমি জড়িত না। কে বলে আমার কথা, তাদের নাম বলেন। আমি সরকারি চাকরি করি, সারা দিন স্কুলে থাকি। এই ইউনিয়নে একটিই পাহাড় আছে, বাকিগুলোর শ্রেণি বাড়ি লেখা।’
যোগাযোগ করা হলে গোপীনাথপুরের চণ্ডীদ্বার ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম প্রথম আলাকে বলেন, সরকারি নথিপত্রে গোপীনাথপুরের বিভিন্ন মৌজায় ১৭ দশমিক ৪০ একর পাহাড় রয়েছে। এর মধ্যে ইউনিয়নের নোয়ামুড়া, কারিয়ারা ও লতুয়ামুড়ায় ৭ দশমিক ৪৩ একর, মধুপুরে ১ দশমিক ২২ একর, পাথারিয়াদ্বারে ৪ দশমিক ১৫ একর, গোপীনাথপুরে ৩ দশমিক ৪০ একর ও রামপুরে ১ দশমিক ২০ একর পাহাড় রয়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক বিসল চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বলেন, কসবায় পাহাড় কাটার বিষয়ে তাঁরা অভিযোগ পেয়েছেন। তদন্ত করছেন। ২০২২ সালে ৪ ও ৫ এপ্রিল পাহাড় কাটার ঘটনায় অভিযান চালিয়ে চারজনকে ১০ লাখ ৯০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
সম্প্রতি সরেজমিনে ও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মধুপুর এলাকার বিশাল পাহাড় কেটে ফেলায় তা সমতলভূমিতে রূপান্তর হয়েছে। একই অবস্থা পাথারিয়াদ্বার, কাজীয়াটুলি ও মানিক্যমুড়ি এলাকার বড় বড় পাহাড়ের। কেটে এমনভাবে সমতল করা হয়েছে যে পাহাড়ের আর অস্তিত্বই নেই।
পাথারিয়াদ্বার পাহাড়ের ওপর ফায়েজ মিয়া ও তাঁর ভাই মৃত ইসলাম খন্দকারের পরিবারের ১৩ সদস্য বসবাস করেন। সেখানে সাতটি বসতঘর রয়েছে। পাহাড় কাটায় ঘরগুলো ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।
রাজনৈতিক আশ্রয় ছাড়া প্রকাশ্যে অবৈধভাবে পাহাড় কাটা সম্ভব হতো না। পাহাড় কাটার ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তরকে জানানো হলে তাঁরা পাশ কাটিয়ে এসি ল্যান্ড অথবা ইউএনওকে জানাতে বলেন। দপ্তরগুলোর গা ছাড়া ভাব আর সমন্বয়হীনতার জন্য পাহাড় কাটা বন্ধ হচ্ছে না।ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পরিবেশবাদী সংগঠন তরী বাংলাদেশের আহ্বায়ক শামীম আহমেদ
কাইজ্জামুড়ির কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, ১৫ থেকে ২০টি পরিবারের ভিটেবাড়ি রয়েছে পাহাড়ে। পাহাড় কেটে মাটি সরানো হলে সমতলে বসবাস করতে সুবিধা হবে বলে তাঁরা মনে করছেন। আমজাদ হোসেন মাস্টার ও মোক্তার হোসেন এসব মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছেন। তাঁরা নাকি ওপর থেকে অনুমতি আনছেন। মধুপুরের লোকজনও জানান, আমজাদ হোসেনরা এসব পাহাড় কাটছেন।
অভিযোগের বিষয়ে ইউপি সদস্য আবদুল মান্নান ভূঁইয়া বলেন, ‘কে বলছে আমি পাহাড় কাটি। আমার বাড়ি কই, পাহাড় কই। মাটিই কাটি না, পাহাড় কীভাবে কাটব। আর আমার ভেকু এখানে না, সিলেটে আছে।’
গোপীনাথপুরে পাহাড় কাটার ঘটনায় চণ্ডীদ্বার ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তা ২০২২ থেকে ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত চারটি মামলা করেছেন। বায়েক ইউনিয়নে মামলা হয়েছে একটি। এর মধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তর তদন্ত করে একটিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন এবং আরেকটিতে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে।
ভূমি কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গোপীনাথপুর ইউনিয়নের লতুয়ামুড়ায় পাহাড় শ্রেণির জমির মাটি বিক্রি করায় ২০২২ সালের ২৮ জুলাই কসবা থানায় একটি মামলা হয়। এতে লতুয়ামুড়ার মো. শাহজাহান, মনির হোসেন, দেলোয়ার হোসেন ও গোপীনাথপুরের বাসিন্দা ভেকু মালিক সুমন মুন্সীকে আসামি করা হয়। চলতি বছরের গত ১৮ ফেব্রুয়ারি গোপীনাথপুরে টিলা কাটার ঘটনায় লোকমান হোসেন ও তৈয়ব আলীকে আসামি করে মামলা হয়। এ ছাড়া উপজেলার পাথারিয়াদ্বারে পাহাড় কাটার ঘটনায় মো. ইউনুসকে আসামি করে মামলা হয়। চলতি বছরের ১৮ মার্চ রামপুরের টানমোড়ায় পাহাড় কাটার ঘটনায় শাহ আলম, তাঁর ভাই জসিম উদ্দিন ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আবদুল মান্নান ভূঁইয়াকে আসামি করে মামলা হয়।
সম্প্রতি সরেজমিনে ও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মধুপুর এলাকার বিশাল পাহাড় কেটে ফেলায় তা সমতলভূমিতে রূপান্তর হয়েছে। একই অবস্থা পাথারিয়াদ্বার, কাজীয়াটুলি ও মানিক্যমুড়ি এলাকার বড় বড় পাহাড়ের। কেটে এমনভাবে সমতল করা হয়েছে যে পাহাড়ের আর অস্তিত্বই নেই।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, লতুয়ামুড়ার মামলাটি তদন্ত করে গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর। কর্তন করা ১২ ফুট উচ্চতার পাহাড় বা টিলার মতো দেখা গেলেও সরকারি সর্বশেষ জরিপ বিএস খতিয়ানে জমির শ্রেণি বাগান হিসেবে উল্লেখ রয়েছে।
২০২২ সালের ১ সেপ্টেম্বর উপজেলার বায়েক ইউনিয়নের কাশিরামপুরে ৯৫৩ দাগে পাহাড় শ্রেণির ভূমি কাটার অভিযোগে এবং সাগরতলা মৌজার বিএস ৪০ দাগে পাহাড় শ্রেণির ভূমির মাটি কেটে বাড়ি তৈরির অভিযোগে মামলা করেন বায়েক ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তা আশ্রাফুল আলম। মামলায় বায়েকের ধোপাখলা গ্রামের আবদুল বারেক, তাঁর ছেলে কামাল, আবদুল খালেক, ইউনুস মিয়া ও ছোটন মিয়াকে আসামি করা হয়। গত ৬ ডিসেম্বর আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শক জোবায়ের হোসেন। গত ৪ জানুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত এটি আমলে নেন।
কসবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ শাহরিয়ার মুক্তার প্রথম আলোকে বলেন, গত মার্চ মাসে পুলিশ নিয়ে অভিযান চালিয়েছেন। কিন্তু সেখানে কাউকে পাওয়া যায়নি। জড়িত ব্যক্তিদের এখনো শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। পাহাড় কাটা চলমান থাকলে অভিযান চালানো হবে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পরিবেশবাদী সংগঠন তরী বাংলাদেশের আহ্বায়ক শামীম আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিক আশ্রয় ছাড়া প্রকাশ্যে অবৈধভাবে পাহাড় কাটা সম্ভব হতো না। পাহাড় কাটার ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তরকে জানানো হলে তাঁরা পাশ কাটিয়ে এসি ল্যান্ড অথবা ইউএনওকে জানাতে বলেন। দপ্তরগুলোর গা ছাড়া ভাব আর সমন্বয়হীনতার জন্য পাহাড় কাটা বন্ধ হচ্ছে না।