‘এককাপড়ে বের হয়েছিলাম, এখনো সেভাবে আছি’

পোড়া বাড়ির সামনে চিয়া প্রু মারমা। আজ বেলা দেড়টায় খাগড়াছড়ির গুইমারার রামেসু বাজারেছবি: জুয়েল শীল

পোড়া বাড়ির সমানে বসে আছেন চিয়া প্রু মারমা (২১)। আগুনে পুড়ে পুরোটা ছাই হয়ে গেছে তাঁদের আধা পাকা ঘরটি। সেখানে পড়ে আছে পোড়া নানা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। জানালা পুড়ে কয়লা। দেয়ালে পোড়া চিহ্ন। যেকোনো মুহূর্তে ধসে পড়তে পারে।

আজ সোমবার দুপুরের দিকে খাগড়াছড়ির গুইমারা উপজেলার রামেসু বাজারে এলাকায় দেখা যায় এই দৃশ্য। গতকাল রোববার বিক্ষোভ ও সহিংসতার সময় আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয় বাড়িটি।

বসতবাড়ি হারিয়ে মা, বাবা ও বোনদের নিয়ে অসহায় অবস্থায় বাড়ির সামনে বসে ছিলেন চিয়া প্রু মারমা। পুড়ে যাওয়া বাড়ি দেখিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন নার্সিং কলেজপড়ুয়া এই ছাত্রী। তিনি বলেন, ‘অবরোধে আমাদের পাড়ার কেউ অংশ নেননি। আমরা কিছুই করিনি। এরপরও বাইরে থেকে এসে লোকজন তাঁদের ঘর পুড়িয়ে দিয়েছে। ঘরের কিছুই রাখেননি। এমনকি বই, কলম খাতাও পুড়িয়ে ফেলছে। একটা জিনিস পর্যন্ত নেই। এককাপড়ে যেভাবে বের হয়ে গিয়েছিলাম, সেভাবেই আছি এখনো।’

কারা আগুন জ্বালিয়েছে, তা বলতে পারবেন না বলে জানান চিয়া প্রু মারমা। তবে মানুষের কাছ থেকে শুনেছেন স্থানীয় বাঙালিরা তাঁদের বাড়িতে আগুন দিয়েছেন বলে অভিযোগ করেন।

সহিংসতার সময় গোলাগুলির শব্দ শুনে সবাই ঘরে দরজা লাগিয়ে বসেছিলেন বলে জানান তিনি। এরপর একপর্যায়ে ঘর থেকে মা–বাবা বোনদের নিয়ে ভয়ে চলে যান। এরপর এসে দেখেন আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে তাঁদের বসতবাড়ি।

চিয়া প্রু মারমার বাবা মূলত কৃষক। এর পাশাপাশি দোকানও রয়েছে। তাঁদের বাড়িটি আধা পাকা। সামনে প্রশস্ত উঠান। বাড়ির আঙিনাজুড়ে গাছের সারি। নানা ধরনের বৃক্ষরাজিতে ভরা বাড়ির প্রাঙ্গণ। আম, লিচু, সুপারি, নারিকেলগাছের সমাহার। আগুনের লেলিহান শিখার উত্তাপ ছুয়ে গেছে নিরীহ বৃক্ষরাজির ওপর। আগুনে পোড়া গাছগুলো মানুষের নির্মমতার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

খাগড়াছড়িতে পাহাড়ি কিশোরীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদে অবরোধ কর্মসূচি পালন করে পাহাড়ি সংগঠন ‘জুম্ম-ছাত্র জনতা’। এই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে গত রোরবার গুইমারার রামেসু বাজারে বিক্ষোভ ও সহিংসতা ঘটে। পাহাড়িদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয় স্থানীয় একটি পক্ষ।

আরও পড়ুন
সড়কে এখনো পড়ে আছে পোড়া মোটরসাইকেল। আজ দুপুরে রামেসু বাজারে
ছবি: প্রথম আলো

বিক্ষোভ ও সহিংসতা চলাকালে তিন পাহাড়ির মৃত্যু হয়। সেনাবাহিনীর মেজরসহ আহত হন অন্তত ২০ জন। এ সময় আগুনে পুড়ে যায় বাজারের দোকানপাট ও বাড়িঘর।

চিয়া প্রু মারমাদের বাড়ি থেকে বের হলেই রামেসু বাজার। সেই রামেসু বাজারের অবস্থা আরও খারাপ। সড়কের দুই পাশে থাকা দোকানপাট ও বসতঘর পুরোপুরি পুড়ে গেছে। শুধু আগুনে পোড়া অবকাঠামোগুলো কোনো রকম দাঁড়িয়ে আছে। কোথাও কোথাও তা–ও নেই। মাটির সঙ্গে মিশে গেছে সব। আগুনে পুড়ে যাওয়া ধুলা উড়ছে। রাস্তা ও রাস্তার পাশে পড়ে ছিল আগুনে পুড়ে যাওয়া মোটরসাইকেলগুলো।

আগুনের উত্তাপ কমে গেলেও উত্তেজনা কমেনি পাড়াবাসীর মধ্যে। আগুনে ছাই হয়ে যাওয়া দোকানঘরের সামনে অবস্থান করছিলেন ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়িরা।

আরও পড়ুন

তাঁদেরই একজন পাইসং মারমা। গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন এই বৃদ্ধা। পাড়ার লোকজন জানান, আগুনে তাঁর দোকান পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

পাড়ার বাসিন্দারা জানান, গুইমারার রামেসু বাজার পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর কাপড়ের জন্য বিখ্যাত। খাগড়াছড়ি শহরসহ আশপাশের উপজেলার লোকজন কাপড় কিনতে এখানে ছুটে আসেন। এবারের আগুনে কাপড়ের দোকানগুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

রামেসু বাজার পাড়ার বাসিন্দা সাহ্লাপ্রু মারমা প্রথম আলোকে বলেন, কারা হামলা করেছে, তা নতুন করে বলার কিছু নেই। পাহাড়ি বাঙালির মধ্যে এ ঘটনা ঘটেছে। তাই বুঝে নেন পাহাড়িদের পাড়ায় কারা আগুন দিয়েছে। আগুনে অন্তুত ৪০টি দোকান, ৫০টি বসতবাড়ি পুড়ে গেছে। কিছু গুদামও পুড়েছে। শুধু পাহাড়িদের ঘরবাড়ি ও দোকানপাট পুড়েছে সেটি নয়, এখানে থাকা বাঙালিদেরও ঘর পুড়েছে। আগুনে এসব ঘরের কিছুই নেই। সব পুড়ে গেছে। মোটরসাইকেল পুড়েছে ১৮টি। মানুষের ঘরবাড়িতে থাকা গরু–ছাগলও লুট করে নিয়ে গেছে।

আরও পড়ুন

আগুনে পাহাড়িদের পাশাপাশি বাঙালিদেরও দোকান ও প্রতিষ্ঠান ভবন পুড়েছে। বাজারের প্রবেশ মুখে গণেশ ঘোষ ও সুমন ঘোষদের পারিবারিক মালিকানাধীন দুটি ভবন, একটি করাতকল, একটি হলুদের গুদাম পুড়ে গেছে আগুনে।

আর পাহাড়িদের বাড়ি ও দোকানপাটে বাঙালিদের আগুন দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন গুইমারার স্থানীয় বাসিন্দা ওষুধ দোকানি হাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, সেনাবাহিনীর মেজরসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ওপর হামলার কারণে স্থানীয় লোকজন ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন। তবে লোকজন কোথাও আগুন দেননি।