খাগড়াছড়িতে কী হচ্ছে, এখন পর্যন্ত যা যা ঘটল

খাগড়াছড়ির গুইমারার রামেসু বাজারে আগুন দেওয়া হয়ছবি : স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত

খাগড়াছড়িতে এক কিশোরীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগের ঘটনার প্রতিবাদে গত পাঁচ দিন ধরে (বুধবার থেকে রোববার) উত্তেজনা বিরাজ করছে। সড়ক অবরোধ চলার সময় সংঘর্ষ, ইটপাটকেল নিক্ষেপেরও ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে শেষ পর্যন্ত প্রশাসন অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে। এর মধ্যেই খাগড়াছড়ি সদরের পাশের উপজেলা গুইমারা বাজারে আগুন দেওয়া ও সংঘর্ষ ঘটনা ঘটেছে। শেষে আজ রোববার গুলিতে তিনজন নিহত হয়েছেন। আহত হন সেনাবাহিনীর সদস্য, পুলিশসহ অন্তত ২০ জন।

খাগড়াছড়ি জেলা শহর এখন থমথমে। সব দোকানপাট বন্ধ। লোকজনের মধ্যে বিরাজ করছে আতঙ্ক। তবে পুলিশ বলছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এদিকে জুম্ম ছাত্র-জনতা তাদের দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত অনির্দিষ্টকালের সড়ক অবরোধসহ তাদের কর্মসূচি চালিয়ে যাবে বলে আজ ঘোষণা দিয়েছে। জুম্ম ছাত্র-জনতা নামের ফেসবুক পেজে পোস্ট করা বিবৃতিতে তা জানানো হয়। এতে তারা আট দফা দাবি দিয়েছে।  

ঘটনার সূত্রপাত যেভাবে

গত মঙ্গলবার রাত ৯টায় প্রাইভেট পড়ে ফেরার পথে স্কুলছাত্রী কিশোরী দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়। ওই দিন রাত ১১টার দিকে অচেতন অবস্থায় একটি খেত থেকে তাকে উদ্ধার করেন স্বজনেরা। এ ঘটনায় কিশোরীর বাবার মামলার পর জড়িত থাকার অভিযোগে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাঁর নাম শয়ন শীল (২১)। তাঁকে ছয় দিনের রিমান্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত।

পরদিন বুধবার থেকে জুম্ম ছাত্র-জনতা ধর্ষণের প্রতিবাদে আন্দোলন শুরু করে। তাদের ডাকে বৃহস্পতিবার আধা বেলা সড়ক অবরোধ কর্মসূচি পালিত হয়। পরে শুক্রবার নারী নিপীড়নবিরোধী সমাবেশ পালন করেন আন্দোলনকারীরা।

খাগড়াছড়িতে পাহাড়ি কিশোরীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ করে সচেতন ছাত্র-যুব-নাগরিক সমাজ। আজ বিকেল ৫টায় চট্টগ্রাম নগরের চেরাগী পাহাড় মোড় এলাকায়
ছবি: সৌরভ দাশ

শুক্রবার কোনো কর্মসূচি ছিল না। তবে পরদিন শনিবার সকাল–সন্ধ্যা অবরোধ ডাকা হয়। সেদিন সদর উপজেলা পরিষদ প্রাঙ্গণে অবরোধকারীদের সঙ্গে স্থানীয় একটি পক্ষের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। তখন উভয় পক্ষের চারজন আহত হয়েছেন বলে দাবি করা হয়। পরে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা গিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিলেও বিকেল চারটার দিকে শহরের মহাজনপাড়া এলাকায় আবারও সংঘর্ষ বেধে যায়। এ সময় মহাজনপাড়া, নারকেলবাগানসহ বিভিন্ন এলাকায় দোকানপাটে ভাঙচুর চালানো হয়। সেদিনে দুপুর সাড়ে ১২টার থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত সদরের চারটি স্থানে দফায় দফায় সংঘর্ষ ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হয়।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রশাসন শনিবার বেলা দুইটার পর সদর, পৌর এলাকা ও গুইমারায় ১৪৪ ধারা জারি করে।

সড়ক অবরোধ, গুলিতে নিহত ৩

অবরোধের কারণে চলেনি কোনো যানবাহন। আজ সকালে খাগড়াছড়ির চেঙ্গী স্কয়ার এলাকায়
ছবি: জয়ন্তী দেওয়ান

ধর্ষণের প্রতিবাদে ‘জুম্ম-ছাত্র জনতা’র ব্যানারে অবরোধ চলাকালে আজ বেলা একটার দিকে গুইমারার রামেসু বাজারে আগুন দেওয়া হয়েছে। আগুনে বাজারের বেশ কয়েকটি দোকান পুড়ে যায়। এ সময় বাজারের পাশে থাকা বসতঘরও আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাজারটি চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি সড়ক থেকে প্রায় ১০০ গজ দূরে।

বাজারে আগুন দেওয়ার ভিডিও ও ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওতে আগুনে বাজারের দোকানপাট জ্বলতে দেখা যায়। বাজারের দোকানমালিকদের অধিকাংশ পাহাড়ি বলে জানা গেছে। এ ঘটনার পর খাগড়াছড়ির গুইমারা উপজেলায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করে। এলাকাজুড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ছিল টহল। এর আগে দুপুরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে অবরোধের সমর্থনকারীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় গুলির শব্দ শোনা যায়।

খাগড়াছড়ি সদরে খোলেনি কোনো দোকানপাট। আজ সকালে
ছবি: প্রথম আলো

প্রত্যক্ষদর্শী মংসাজাই মারমা ও কংজরী মারমা জানান, অবরোধের সমর্থনে তাঁরা খাদ্যগুদামের সামনের সড়কের ওপর দাঁড়িয়ে শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করছিলেন। এ সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এলে তাঁদের সঙ্গে কথা-কাটাকাটি হয়। কথা-কাটাকাটির এক পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাঁদের ওপর গুলি চালান বলে অভিযোগ করেন এই দুজন। তাঁরা বলেন, গুলির পরপরই লোকজন ভয়ে দিগ্‌বিদিক পালিয়ে যান। এরপর ২০-২৫ জন লোক এসে রামেসু বাজার ও বসতবাড়ি লুটপাট করেন এবং যাওয়ার সময় আগুন ধরিয়ে দেন। এসব লোকের সঙ্গে মুখোশ পরা লোকও ছিল। এ সময় দোকানপাট ও বসতবাড়ির সঙ্গে অনেকগুলো মোটরসাইকেলেও আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।

গুলিতে তিনজনের মৃত্যুর বিষয়টি প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেন চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপমহাপুলিশ পরিদর্শক (ডিআইজি) আহসান হাবিব পলাশ। আজ সন্ধ্যায় তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গুইমারায় গুলিতে তিনজন নিহতের খবর পাওয়া গেছে। তাঁদের লাশ হাসপাতালে রয়েছে। তবে কার গুলিতে কীভাবে মারা গেছে, বিস্তারিত জানা যায়নি। তিনি আরও বলেন, গুলিতে তিনজন নিহত হওয়ার পাশাপাশি আরও তিনজন আহত হয়েছেন।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে খাগড়াছড়ি জেলা সিভিল সার্জন মোহাম্মদ সাবের প্রথম আলোকে বলেন, গুইমারা থেকে তিনজন পুরুষের লাশ এসেছে খাগড়াছড়ি জেলা হাসপাতালে। তাঁদের লাশ মর্গে রাখা হয়েছে। আগামীকাল সোমবার সকালে ময়নাতদন্ত করা হবে। তিনি আরও বলেন, হাসপাতালে গুইমারা থেকে আনা আহত চারজন চিকিৎসাধীন।

আহত তিনজনের পরিচয় জানা গেছে। তাঁরা হলেন বিকাশ ত্রিপুরা (২৬), চিংকেউ মারমা (২৬) ও উগ্য মারমা (২২)। তাঁরা খাগড়াছড়ি জেলা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এর মধ্যে চিংকেউ মারমা বাঁ পায়ের হাঁটুতে গুলিবিদ্ধ হয়ে অপর পাশ দিয়ে বের হয়ে গেছে। তিনজনের অবস্থা স্বাভাবিক রয়েছে বলে হাসপাতাল সূত্র জানায়।

আরও পড়ুন

শান্ত থাকার অনুরোধ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতেও তিনজন পাহাড়ির নিহতের বিষয়টি জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়, খাগড়াছড়ি জেলার গুইমারা উপজেলায় দুষ্কৃতকারীদের হামলায় তিনজন পাহাড়ি নিহত এবং মেজরসহ ১৩ জন সেনাসদস্য, গুইমারা থানার ওসিসহ তিনজন পুলিশ সদস্য এবং আরও অনেকে আহতের ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে গভীর দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে আশ্বস্ত করা হয়েছে, এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অতি শিগগির তদন্তপূর্বক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কোনো অপরাধীকেই ছাড় দেওয়া হবে না। ততক্ষণ পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধৈর্য ধারণপূর্বক শান্ত থাকার জন্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়েছে।

সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে অবরোধকারীদের অবস্থান। গতকাল সকালে চেঙ্গী ব্রিজ এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

তৃতীয় পক্ষের ইন্ধন রয়েছে: সুপ্রদীপ চাকমা

খাগড়াছড়িতে চলমান পরিস্থিতিতে তৃতীয় পক্ষের ইন্ধন রয়েছে বলে আজ দুপুরে খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসনের সম্মেলনকক্ষে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, আন্দোলনের নামে সহিংসতা তৈরি করে একটি পক্ষ নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে। এ সময় পাহাড়ে অবৈধ অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন তিনি।

আজকে নতুন নতুন ইস্যু তৈরি করে পাহাড়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করার চেষ্টা চালাচ্ছে। সরকারের কাছে প্রধান চ্যালেঞ্জ হলে নির্বাচন দেওয়া। কেউ যদি নির্বাচন বানচাল করার চেষ্টা করে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নতুন করে কোনো ইস্যু তৈরি করতে দেওয়া হবে না। এখন থেকে প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া কেউ মিছিল–মিটিং করতে পারবে না। সভায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সুশীল সংগঠনের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।

আরও পড়ুন

থমথমে খাগড়াছড়ি, আটকে খাগড়াছড়িগামী যাত্রীরা

রোববার বিকেল সাড়ে চারটা। চট্টগ্রাম নগরের অক্সিজেন এলাকা। সড়কের পাশেই খাগড়াছড়ি বাস কাউন্টার। সেখানে মানুষের জটলা। কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে প্রহর গুনছেন বাসের জন্য। পাশে দাঁড়িয়ে ছিল বাস। কিন্তু কখন ছাড়বে, তা কেউ জানে না। এ নিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে কাউন্টারের কর্মীর এক দফা বচসা হয়ে যায়।

যাত্রীদের একজন সাখাওয়াত হোসেন। বাড়ি মাটিরাঙ্গা। করেন কৃষিকাজ। নগরের অক্সিজেন এলাকায় মেয়ের বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন তিন দিন আগে। আজ গ্রামের বাড়ি খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গায় ফিরে যাওয়ার জন্য আসেন বাস কাউন্টারে।

সাখাওয়াত রোববার বিকেল সাড়ে চারটায় প্রথম আলোকে বলেন, আড়াই–তিন ঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। বাস আসবে আসবে বলছে, কিন্তু আসে না। গুইমারায় মারামারি হচ্ছে। এ কারণে যাবে কি যাবে না, তা–ও ঠিকমতো বলতে পারছেন না কাউন্টারের লোকজন। তারপরেও যদি যায়, তাই অপেক্ষা করছেন। আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবেন। গাড়ি না পেলে মেয়ের বাসায় ফিরে যাবেন।

কাউন্টারে থাকা ব্যক্তি বলেন, খাগড়াছড়িতে ঝামেলা হচ্ছে। পথে পথে ব্যারিকেড, গাছ ফেলে দেওয়া হয়েছে। এ অবস্থায় গাড়ি যাওয়া সম্ভব নয়। তারপরও চেষ্টা করছেন বাস নিয়ে যেতে। তবে পারবেন বলে মনে হয় না।

গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিলেন এক দম্পতি। পূজাতে যাবেন গ্রামের বাড়ি মাটিরাঙ্গা। তবে তাঁদের মতে, পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে যেতে পারবেন না। শেষ পর্যন্ত তাঁরা যেতে পারেননি।

অন্যদিকে খাগড়াছড়ি শহরে আজ সকাল থেকে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। শহরের মোড়ে মোড়ে নিরাপত্তা বাহিনীর অবস্থান ছিল। বাজার ও বাজারের আশপাশে কোনো দোকানপাট খোলেনি। প্রয়োজনীয় কাজে যাঁরা বের হচ্ছেন, তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে নিরাপত্তা বাহিনী।