দীর্ঘদিন ধরে পরিকল্পনা করে আহমদিয়াদের ওপর হামলা

হামলায় গুড়িয়ে দেওয়া ঘরের টিন এদিক-ওদিক ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রয়েছে। গতকাল পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার সোনাচান্দি এলাকার রফিক আফ্রাদের বাড়িতেছবি: প্রথম আলো

গাছগাছালি ঘেরা উঠান পেরিয়ে পাকা বাড়ি। প্রবেশপথে গেট। তাতে ভারী কিছুর আঘাতের চিহ্ন স্পষ্ট। আগুনের শিখায় কালো হয়ে গেছে ঘরের দেয়াল। মেঝেতে পড়ে আছে আসবাবের পোড়া ছাই। আবার কোনো ঘর একেবারেই ফাঁকা। আগুনের উত্তাপে কোনো কোনো বাড়ির মেঝে ফুলে উঠেছে। এগুলো পঞ্চগড় সদর উপজেলার আহম্মদনগর, বোদা উপজেলার ফুলতলা, শালশিড়ি ও সোনাচান্দি এলাকার আহমদিয়া সম্প্রদায়ের লোকজনের বাড়ির চিত্র।

পুলিশ প্রশাসন ও ভুক্তভোগী লোকজন জানান, আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘ পরিকল্পনা করেই হামলা চালানো হয়েছে। মালামাল লুট করে নেওয়ার পর করা হয়েছে অগ্নিসংযোগ।

আরও পড়ুন

আজ মঙ্গলবার সরেজমিন ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ঘুরে দেখা যায়, চারদিকে পোড়া ঘরবাড়ি। তার পাশে বিভিন্ন বয়সের মানুষের জটলা। অপরিচিত লোকজন দেখলেই যেন আঁতকে উঠছেন তাঁরা। কাছে আসার বদলে উল্টো দূরে সরে যাচ্ছিলেন।

আহম্মদনগরে ঢুকতেই পাকা সড়ক। সড়কের দক্ষিণে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে পোড়া টিন। পাশেই হাফিজুল ইসলামের বাড়ি। তাঁর বাড়ির প্রধান গেটটি লোহার তৈরি। গত শুক্রবার হামলার সময় সেই লোহার কলাপসিবল গেটটি ভেঙে লুটপাট চালায় দুর্বৃত্তরা। পরে বাড়িতে দেওয়া হয় আগুন। অন্যপাশে রাহিমা খাতুনের পাকা বাড়ি। লোহার কলাপসিবল গেট ভেঙে তাঁর বাড়িতেও লুটপাট চালায় দুর্বৃত্তরা। আগুনের উত্তাপে সেখানে ঘরের মেঝে ফুলে উঠেছে। কালো হয়ে গেছে দেয়ালগুলো।

আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ওপর হামলায় রেহাই পায়নি বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. হানিফের বাড়ি। গতকাল পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার ফুলতলা এলাকায়
ছবি : প্রথম আলো

হাফিজুলের পাশে মুদিদোকানি শিহাব মুন্সীর বাড়ি। তাঁর বাড়িও পাকা। প্রবেশমুখে কলাপসিবল গেট। জানালা লোহার গ্রিলে ঘেরা। শিহাব মুন্সীর বাড়ির গেটের তালা ভেঙে বাড়ির মালামাল লুটপাট করা হয়েছে। লুটপাট শেষে আসবাব জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। আগুনে বাড়ির দেয়াল পুড়ে গেছে। বাড়ির উঠানে পড়ে আছে স্টিলের ট্রাঙ্ক। গৃহবধূর গচ্ছিত জিনিসগুলো পুড়ে ছাই হয়েছে। পাশের মহসিন মোড়লের পাকা বাড়িটিরও একই অবস্থা। সেই বাড়ির মালামাল লুট করে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। কেটে ফেলা হয়েছে গাছপালা।

শালশিরি গ্রামে শামসুল আলমের বাড়ি। ঋণ নিয়ে একটি ট্রাক্টর কিনেছিলেন। বোরো ও আমন মৌসুমে অন্যের জমিতে ট্রাক্টর দিয়ে হালচাষ করতেন। জীবিকার একমাত্র মাধ্যম ছিল ট্রাক্টরটি। দুর্বৃত্তরা তাঁর বাড়িতেও হামলা করে ট্রাক্টরটি পুড়িয়ে দিয়েছে। ঘরবাড়িতে দেওয়া হয়েছে আগুন।

আরও পড়ুন

পাশের সোনাচান্দি গ্রামে রফিক আফ্রাদের বাড়ি। আগুন নিভে গেলেও পোড়াবাড়ি থেকে ধোঁয়া উড়ছে এখনো। বাড়ির সাতটি ঘরের পোড়া টিন এদিক-ওদিক ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রয়েছে। রফিক আফ্রাদ বললেন, ‘বাড়ির সব দামি জিনিস লুট করে নেওয়ার পর আগুন দেওয়া হয়েছে। বাড়ির কোনো ঘরই বাকি নেই। আমাদের শেষ করে দিতেই এ হামলা চালানো হয়েছে। আমরা ভয়ে পালিয়ে গেলে আমাদের সহায়সম্পত্তি দখল করার পাঁয়তারা করেছে দুর্বৃত্তরা।’

গত শুক্রবার অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত রাহিমা খাতুনের ঘরের মেঝে। গতকাল পঞ্চগড় সদর উপজেলার আহম্মদনগরে
ছবি : প্রথম আলো

রফিকের স্ত্রী বেদেনা বেগম বলেন, ‘সবায় জলসাত চলে গেইছে। মুই সেলাও বাড়িত। প্রথমে তিন-চাইর জন দৌড়ায় আসিল। জারকিনোত পানির মতো কী জানি ঘরলাত ছিটায় দিল। তারপর হামাক যেই-সেই কহে গাইল দিবা ধরিল। আর একজন সালাইটা মারেহেনে (দেশলাই জ্বালিয়ে) ঘরলাত আগুন দিবা ধরিল। কান্দেছু আর চেঁচাছু। চোখের সামনোতে চাইরটা ব্যাটার বাড়ি আর নিজের ঘরটা জ্বলে শেষ হইল।’

ফুলতলা বাজরে যে কয়েকটা বড় মুদিদোকান রয়েছে, তার মধ্যে একটি নুর উদ্দিন আহমেদের। সেদিন তাঁর দোকানের মালামালও লুটপাট করা হয়েছে। এ ঘটনায় তিনি প্রায় ২৩ লাখ টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন বলে জানান।

সাদেক আহমদ বাড়িতে বিদেশি গরুর খামার ছিল তাঁর। সেদিনের হামলায়ও তাঁর বাড়িঘরসহ খামারটি পুড়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘আমি পথে বসে গেছি। আমার এখন মরণ ছাড়া কোনো উপায় নেই।

আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ঘরবাড়িতে হামলার সময় সোলায়মান আহমদের বাগানের সুপারি গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। গতকাল পঞ্চগড় সদরের ডাংগাপাড়ায়
ছবি : প্রথম আলো

এ ছাড়া ফুলতলা বাজারে নুর আলমের মুদিদোকান, তানভির আহমদ, হাফিজুল ইসলাম, মোবারক আহমদ, মোস্তাক আহমদসহ আরও কয়েকজনের দোকানের মালামাল লুট করে দোকান পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন

আহম্মদনগরের বাসিন্দা মাহমুদ আহমেদের বাড়িতেও হামলা চালিয়ে লুটপাটের পর অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। হামলা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘জলসা উপলক্ষে বাড়িতে আত্মীয়স্বজনেরা এসেছিলেন। ঘরে সবার মূল্যবান জিনিস ছিল। আমাদের বাড়িতে হামলা চালিয়ে প্রথমে বাড়ির মালামাল লুট করা হয়েছে। তারপর আগুন দেওয়া হয়েছে। পোড়ার ধরন দেখে মনে হচ্ছে, পেট্রলের পাশাপাশি গানপাউডার ব্যবহার করা হয়েছে। তা না হলে ছাদ ঢালাইয়ের বাড়িও নিমেষেই আগুনে পুড়ে যাওয়ার কথা না। আহমদিয়া সম্প্রদায়ের লোকজনকে নিঃশেষ করতেই এই হামলা করা হয়েছে। তা না হলে সাধারণ এই মানুষগুলোর কষ্টে গড়ে তোলা ঘরবাড়ি, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান এভাবে জ্বালিয়ে দিত না।’

আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি শুধু পোড়ানো হয়নি, দেলোয়ার হোসেনের ইটভাটাও জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। গতকাল পঞ্চগড় বোদা উপজেলার মানিকনগরে
ছবি : প্রথম আলো

আহমদিয়াদের সালানা জলসার আহ্বায়ক আহমদ তবশির চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের ওপর হামলা এক দিনের পরিকল্পনায় হয়নি। প্রথমে বাড়ির সামনে লাল ও সাদা কাপড় টাঙিয়ে বাড়ি চিহ্নিত করা হয়েছে। পরে  টাঙানো কাপড় দেখে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের লোকজনের বাড়িতে বাড়িতে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। যারা এসব কাজ করেছে, তারা প্রশিক্ষিত মনে হয়েছে। হামলায় গ্রিল কাটা ও দেয়াল ভাঙারও যন্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। আগুন জ্বালানোর জন্য গানপাউডার আর পেট্রলও ব্যবহার করা হয়েছে। আহমদিয়া সম্প্রদায় লোকজনকে নিশ্চিহ্ন করতেই এই হামলা।’

আরও পড়ুন

পঞ্চগড়ের পুলিশ সুপার এস এম সিরাজুল হুদা বলেন, ‘এখানে পেট্রল দিয়ে ট্রাফিক অফিস জ্বালিয়ে দেওয়া, র‍্যাবের গাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া, ঘরবাড়ি মুহূর্তের মধ্যে পুড়িয়ে দেওয়া দেখে খুব স্বাভাবিকভাবেই মনে হচ্ছে, এটা পূর্বপরিকল্পিত এবং একটি স্বার্থান্বেষী মহলের দীর্ঘ সময়ের পরিকল্পনার কাজ। আহমদিয়া সম্প্রদায়ের লোকজনের বাড়িঘরসহ যেসব জায়গায় অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে, সেখানে পেট্রল ব্যবহার করা হয়েছে এটা নিশ্চিত। সেই সঙ্গে গানপাউডারও ব্যবহার হতে পারে। এটা নির্ণয়ের জন্য সিআইডির টিম কাজ করছে। ঘটনাস্থল থেকে কিছু আলামত সংগ্রহ করা হচ্ছে। ফরেনসিক যাচাই-বাছাই করেই এই বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে। তবে হামলার ধরন দেখে হামলাকারীরা প্রশিক্ষিত লোকজন বলে মনে হয়েছে।’

আরও পড়ুন