বাসের ফিটনেস নৈরাজ্য, ‘ব’-এর মতো চলছে ‘জ’

রাজশাহীতে ‘জ’ সিরিয়ালের বাসে ৩১টি আসন থাকার কথা থাকলেও আছে ৪৯টি। অভ্যন্তরীণ রুটে চলাচলকারী প্রায় সব বাসের চিত্র এমনই। জায়গা সংকুলানের কারণে এসব বাসে উঠে হাঁটু ভাঁজ করে বসতে পারেন না যাত্রীরা
ছবি: প্রথম আলো

সপ্তাহখানেক আগের কথা। রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার বানেশ্বরে একটি বাসে ওঠেন এক যাত্রী। যাবেন চারঘাটে। তবে আসন ফাঁকা পেয়েও তিনি বসতে পারছিলেন না। দুই আসনের মাঝে কিছুতেই হাঁটু ভাঁজ করে ঢোকাতে পারছিলেন না। অসহায় যাত্রী বাসের কন্ডাক্টরকে ডেকে সমস্যাটার কথা বললেন। শুনে কন্ডাক্টর বললেন, ‘আপনারা বসতেই জানেন না। আপনাদের বসা শেখাতে হবে।’ এরপর যাত্রী আর উত্তর দেওয়ার ভাষা খুঁজে পেলেন না।

রাজশাহী শহর থেকে বিভিন্ন উপজেলায় চলাচলকারী অধিকাংশ বাসের অবস্থা এমনই। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষে (বিআরটিএ) খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ‘ব’ সিরিজের গাড়িগুলো ৫২ আসনের হয়। আর ‘জ’ সিরিজের গাড়িগুলো ৩১ আসনের। ওই যাত্রী যে বাসটিতে উঠেছিলেন, সেটি ছিল ৪৮ আসনের। বোঝা গেল, আসন বাড়িয়ে ‘জ’ সিরিজের বাসকে ‘ব’ সিরিজ বানানো হয়েছে। এসব বাসে উঠে যাত্রীরা বিপাকে পড়েন। তাঁরা দুই আসনের মাঝে হাঁটু ভাঁজ করে বসতে পারেন না।

সেদিনের কন্ডাক্টরের সঙ্গে যাত্রীর বাগ্‌বিতণ্ডা অন্যদিকে গড়াল। একজন যাত্রী আসনে বসে পেছনে হেলান দিতে গিয়েই মাথায় আঘাত পেলেন। যাত্রীর হেলান দেওয়ার সময় মাথা রাখার জায়গায় একটি লোহার পাত আলগা হয়ে ছিল। আসনের কাভারে সেটি ঢাকা পড়েছিল। যাত্রী হেলান দেওয়ার পরপরই টের পান। এ নিয়ে আরেক দফা হইচই শুরু হয়। যাত্রী দাবি করে বসলেন, ‘এই বাসের কী ফিটনেস সার্টিফিকেট আছে?’ কন্ডাক্টর বড়াই করে বললেন, ‘কয়েক দিন আগেই সার্টিফিকেট নিয়ে এসেছেন। দেখতে চাইলে দেখাতে পারেন।’

সেখান থেকেই বিআরটিএর এক কর্মকর্তাকে ফোন করে জানা গেল, বাসে ফিটনেসের শর্ত আছে ৬২টি। সেই শর্তের মধ্যে ১৮ নম্বরে বসার আসন ঠিক আছে কি না, সে ব্যাপারে বলা হয়েছে। আর ৬২ নম্বরে বলা আছে রঙের কথা। বাসের রংও ঠিক থাকতে হবে। এরপর একটি বাসের ফিটনেস সনদ পাওয়ার কথা। রং তো দূরের কথা, বাসের আসন ব্যবস্থাই বিপজ্জনক হয়ে আছে। কীভাবে ফিটনেস সার্টিফিকেট পেলেন, জানতে চাইলে কন্ডাক্টর কোনো কথা বলেন না।

আরও পড়ুন

অন্য বাসের একজন কন্ডাক্টর যাত্রী হিসেবে ওই বাসে যাচ্ছিলেন। তিনি বললেন, রাস্তায় তাঁদেরও অনেক ঝামেলা মেটাতে হয়। কাগজপত্র ঠিক থাকলেও টোল প্লাজায় বেশি টোল দিতে হয়। এক যাত্রী বেশি টোল দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘না দিয়ে যে উপায় নেই। তাঁরা কাগজপত্র দেখেও সন্তুষ্ট হন না। বলেন, “তোমার গাড়ির সিট গুনব।”’ আলাপচারিতায় বোঝা গেল, বাসের আসন গুনলেই সমস্যা বেরিয়ে আসে।

রাজশাহী শহর থেকে বিভিন্ন উপজেলায় প্রতিদিন ২০০ থেকে ২২৫টি লোকাল বাস চলাচল করে। ওই বাসের বেশ কয়েকটিতে ঢুঁ মেরে দেখে গেছে, কোনোটির আসনই ‘জ’ সিরিজ অনুযায়ী ৩১টি নেই। বেশির ভাগ বাসের আকার ৩১ আসনের। নম্বর প্লেটেও লেখা আছে ‘জ’। অথচ আসন ‘ব’ সিরিজের বা বড় বাসের প্রায় কাছাকাছি।

আরও পড়ুন

তানোর-রাজশাহীর মধ্যে চলাচলকারী ‘জ’ সিরিজের একটি বাসের আসন পাওয়া গেল ৪৯টি। একই সিরিজের রাজশাহী-তাহেরপুরে চলাচলকারী একটি বাসের আসন গুনে পাওয়া গেল ৪২টি। আবার রাজশাহী ও বাগমারার ভবানীগঞ্জের মধ্যে চলাচলকারী ‘ব’ সিরিজের একটি বাসের আসন পাওয়া গেল ৩৭টি। ওই বাসটির নম্বর প্লেটে ‘ব’ কীভাবে এল তা-ও বোঝা গেল না।

বিআরটিএর রাজশাহী অঞ্চলের সহকারী পরিচালক আব্দুল খালেক প্রথম আলোকে বলেন, রাজশাহী বিআরটিএর নিবন্ধিত গাড়ি নেই বললেই চলে। রাজশাহীতে বাস কেনাবেচাও হয় না। বিক্রয়কেন্দ্রও নেই। এ জন্য রাজশাহীতে বাস কেউ নিবন্ধন করতে আসেন না। তিনি বলেন, রাজশাহী বিআরটিএতে নিবন্ধিত বাসের সংখ্যা ৩০০-এর বেশি হবে না। সব গাড়িই রাজশাহীর বাইরের। ‘জ’ সিরিজের গাড়িতে এত আসন কীভাবে এবং ফিটনেস সনদ কীভাবে পেল জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তারা গাড়ি দেখাতে আনার সময় অতিরিক্ত আসন খুলে রেখে আসে। এ জন্য ধরা যায় না।’

আরও পড়ুন

রাজশাহী সড়ক পরিবহন গ্রুপের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাফকাত মঞ্জুরও বেশ কয়েকটি বাসের মালিক। তাঁর কাছে ‘জ’ সিরিজ আর ‘ব’ সিরিজের আসন অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে বিস্ময় প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘ওরে বাপরে এত দূর জেনে গেছেন।’ তিনি বলেন, লোকাল রুটে এই গাড়িগুলো চলে। সিএনজিচালিত অটোরিকশার দাপটে অনেক রুটে তাঁদের বাস বন্ধ হয়ে গেছে। এখন মাত্র ২০০ থেকে ২২৫টা গাড়ি প্রতিদিন চলাচল করে।

সাফকাত মঞ্জুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেখেন তো, মানুষ সিএনজিচালিত অটোরিকশায় কেমন চাপাচাপি করে যায়। তাঁদের তো অসুবিধা হয় না। বাসেও একটু যায়, এতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।’ তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘বাসের ২০০টা যন্ত্রাংশ থাকে। সবটারই দাম বেড়েছে। ১৬ হাজার টাকার টায়ারের দাম হয়েছে ২৪ হাজার টাকা। শ্রমিকদের বেতন বেড়েছে। আমরা কিছু মানুষ পরিবহন ব্যবসা করি। আমরা আর চলতে পারছি না।’