যশোরের জলাবদ্ধ ভবদহ এলাকায় মাছের ঘের তৈরি শুরু হয় দুই দশক আগে। পানির সহজলভ্যতায় দেড় দশক আগে তা ব্যাপকভাবে প্রসারিত হয়। কিন্তু নদী ও খাল ভরাট হয়ে ঘেরের পানিনিষ্কাশনের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। বর্ষায় ঘের এলাকা প্লাবিত হয়ে জীবনযাত্রা অচল হয়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে ঘের স্থাপনে নীতিমালা তৈরি করে নিবন্ধনের ব্যবস্থা করেছে সরকার। কিন্তু ঘেরমালিকেরা সেই নীতিমালা মানছেন না। অনেকে বিষয়টি জানেনও না। এতে ভবদহের জলাবদ্ধতার সংকট আরও প্রকট হচ্ছে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, ভবদহ এলাকায় ১২ হাজার ৯৮৬ হেক্টর জমিতে ১৮ হাজার ২৪০টি মাছের ঘের আছে। এর মধ্যে মাত্র ৩২ জন ঘেরের নিবন্ধন করেছেন। নিবন্ধনের আবেদন করেছেন মাত্র ২০ জন। বাকিরা এখনো নিবন্ধনের বাইরে।
যশোরের অভয়নগর, মনিরামপুর ও কেশবপুর এবং খুলনার ডুমুরিয়া ও ফুলতলা উপজেলার অংশবিশেষ নিয়ে ভবদহ অঞ্চল। এখানে অন্তত ৫২টি ছোট-বড় বিল আছে। বিলের ভেতর দিয়ে মুক্তেশ্বরী, টেকা, হরি ও শ্রী নদ-নদী প্রবাহিত। এগুলোর জোয়ারভাটার সঙ্গে এলাকার বিলের পানি ওঠানামা করে। জলাবদ্ধতা নিরসন করে পরিকল্পিতভাবে মৎস্যঘের স্থাপন; সরকারি খাল, নদী ও জমি অবৈধ দখল থেকে উদ্ধার করে খাল ও নদীর নাব্যতা বৃদ্ধির জন্য ২০১৯ সালে মৎস্যঘের স্থাপন নীতিমালা প্রণয়ন করে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়।
জানতে চাইলে মৎস্যঘের স্থাপন ও ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক মো. আজাহারুল ইসলাম বলেন, ভবদহ এলাকায় মৎস্যঘের স্থাপন নীতিমালা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মৎস্যঘেরের নিবন্ধন নেওয়া শুরু হয়েছে।
নীতিমালায় বলা হয়, ঘের করতে হলে সংশ্লিষ্ট উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার দপ্তর থেকে নিবন্ধন নিতে হবে। কেউ নীতিমালা ভঙ্গ করলে নিবন্ধন কর্মকর্তা তাঁর নিবন্ধন বাতিল করবেন। সরকারি খাল, সরকারি জমি, নদীর পাড় ও নদীর মধ্যে ঘের স্থাপন করা যাবে না। নদী, খাল ও খাসজমি ইজারা নিয়ে করা ঘেরের ইজারা বাতিল ও ঘের অপসারণ করে পানির প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে।
নীতিমালায় আরও বলা হয়, প্রতিটি ঘেরের আয়তন হবে সর্বোচ্চ ১৫ হেক্টর, সমবায় সমিতির ক্ষেত্রে ৫০ হেক্টর। ঘেরমালিক ঘেরের চারদিকে নিজ খরচে বাঁধ বা পাড় দেবেন, বাঁধের সঙ্গে সরকারি রাস্তা থাকলে বাঁধের উচ্চতা রাস্তার থেকে কম হবে। পানিনিষ্কাশনের সুবিধার্থে প্রত্যেক মালিককে ঘেরের বাঁধের বাইরে কমপক্ষে আড়াই ফুট করে জায়গা ছাড়তে হবে। উভয় ঘেরের পাড়ের মাঝে পানিনিষ্কাশনে অন্তত পাঁচ ফুট জায়গা থাকবে। সরকারি রাস্তা ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধকে ঘেরের বাঁধ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না।
সরেজমিনে বিল বোকড়, বিল খুকশিয়া, বিল কেদারিয়া, বিল কপালিয়া, বিল ডুমুর, বিল পায়রা, বিল ঝিকরা ও চাতরার বিল ঘুরে দেখা গেছে, যত দূর চোখ যায় শুধু মাছের ঘের। অধিকাংশ ঘের নীতিমালা মেনে করা হয়নি। ঘেরগুলোর আয়তন দশমিক ১৭ হেক্টর (১ বিঘা) থেকে শুরু করে ২০৪ হেক্টর পর্যন্ত। শুধু চাতরার বিলে সমবায় ভিত্তিতে ১০২ হেক্টরে ঘের করা হয়েছে, যা নীতিমালার ৫০ হেক্টরের দ্বিগুণের বেশি। দুই ঘেরের মাঝে আড়াই ফুট করে মোট পাঁচ ফুট জায়গা পানিনিষ্কাশনের জন্য ফাঁকা রাখার কথা থাকলেও তেমন কোনো জায়গা নেই। পাশাপাশি দুই ঘেরের জন্য এক বাঁধ।
মনিরামপুর উপজেলার পাঁচবাড়িয়া, নেবুগাতী, আলীপুর, কুলটিয়া ও লখাইডাঙ্গা এলাকায় মুক্তেশ্বরী নদী; বয়ারঘাটা ও বালিধা এলাকায় টেকা নদী এবং খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার চেঁচুড়ি, দোহাকুলা ও রুদাঘরা এলাকায় হরি নদীর দুই পাড় মাছের ঘেরের বাঁধ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। যদিও নীতিমালায় নদ-নদীর বাঁধকে ঘেরের বাঁধ হিসেবে ব্যবহার করতে নিষেধ করা হয়েছে। এ ছাড়া অভয়নগরের ডুমুরতলা, মনিরামপুরের হাটগাছা, সুজাতপুর এলাকায় নওয়াপাড়া-কালীবাড়ি সড়ক এবং কেশবপুরের কাটাখালী এলাকায় কালীবাড়ি-চুকনগর সড়কের দুই পাশ ঘেরের বাঁধ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
বিল কেদারিয়ায় সাড়ে ৯৩ হেক্টর জমি ইজারা নিয়ে মাছের ঘের করেছেন পরেশ চন্দ্র মণ্ডল। তিনি এখনো ঘেরের নিবন্ধন করেননি। তিনি বলেন, ‘ঘেরের নিবন্ধন করার বিষয়ে আমি জানি না। আজই জানলাম। আমি মৎস্য অফিসে নিবন্ধনের ব্যাপারে খোঁজ নেব।’
তবে এই বিলে প্রায় এক হেক্টর (২০৬ শতক) জমিতে ঘের আছে অভয়নগরের দিঘলিয়া গ্রামের নাসির উদ্দীন গাজীর। তিনি ঘেরের নিবন্ধন করেছেন। তিনি বলেন, ঘের নিবন্ধন করা প্রয়োজন। নিবন্ধন করলে সরকারি সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যাবে।
ভবদহ পানিনিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির প্রধান উপদেষ্টা ইকবাল কবির প্রথম আলোকে হলেন, ভবদহ অঞ্চলের জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ অপরিকল্পিত মৎস্যঘের তৈরি। এ বিষয়ে দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ তাদের দায়িত্ব পালন করছে না। এ জন্য ভবদহের জলাবদ্ধতার সংকট আরও তীব্র হয়েছে।
ভবদহ এলাকায় মৎস্যঘের স্থাপন ও ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যসচিব জেলা মৎস্য কর্মকর্তা সরকার মুহাম্মদ রফিকুল আলম বলেন, মৎস্যঘের নিবন্ধনে ঘেরমালিকদের উদ্বুদ্ধকরণ কার্যক্রম চলমান। ইতিমধ্যে কয়েকজন নিবন্ধন নিয়েছেন। কয়েকজন আবেদন করেছেন। মৎস্যঘের নিবন্ধনে সেনাবাহিনী সহযোগিতা করছে। আশা করা যায়, চলতি বছর ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ ঘেরের নিবন্ধন সম্পন্ন করা যাবে।