নরসিংদীতে মাদ্রাসার শৌচাগার থেকে ছাত্রীর লাশ উদ্ধারের ৪৩ ঘণ্টায়ও মামলা হয়নি

নরসিংদী সদর উপজেলার শেখেরচরের কুড়েরপাড়ের জামিয়া কওমিয়া মহিলা মাদ্রাসা
ছবি: প্রথম আলো

নরসিংদীতে মহিলা মাদ্রাসার শৌচাগার থেকে মাইশা আক্তার (১০) নামের এক ছাত্রীর লাশ উদ্ধারের ঘটনার ৪৩ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও মামলা হয়নি। মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ ঘটনাটিকে ‘আত্মহত্যা’ বলে দাবি করলেও শরীরে আঘাতের চিহ্ন থাকায় ছাত্রীর স্বজনেরা বলছেন, এটা হত্যাকাণ্ড।

গতকাল শুক্রবার রাতে এ ঘটনায় মাইশার বাবা নেছার উদ্দিন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে মাধবদী থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। আজ শনিবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে মাধবদী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রকীবুজ্জামান বলেন, সার্ভারে সমস্যা থাকায় গতকাল রাতে লিখিত অভিযোগটি মামলা হিসেবে নেওয়া যায়নি।

এর আগে গত বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে চারটার দিকে উপজেলার শেখেরচরের কুড়েরপাড়ের জামিয়া কওমিয়া মহিলা মাদ্রাসার শৌচাগারের ভেন্টিলেটরের গ্রিলের সঙ্গে গলায় ফাঁস দেওয়া অবস্থায় মাইশা আক্তারকে উদ্ধার করা হয়। ওই অবস্থায় মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ দ্রুত তাকে নরসিংদী সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিলে সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। মাইশা আক্তার নরসিংদী সদর উপজেলার মাধবদী থানার ভগীরথপুর এলাকার ডাইংশ্রমিক নেছার উদ্দিনের মেয়ে। সে মাদ্রাসায় আবাসিক ছাত্রী হিসেবে থেকে মক্তব দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ত।

আরও পড়ুন

দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও নরসিংদী সদর হাসপাতালে গিয়ে লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন মাধবদী থানার উপপরিদর্শক মাহবুবুল হক। তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে মাইশার কপালের দুই দিকে দুটি আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। তবে সুরতহাল করার সময় ধর্ষণের কোনো ধরনের আলামত পাওয়া যায়নি। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন হাতে পেলে মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত হওয়া যাবে।

লিখিত অভিযোগে বলা হয়েছে, বৃহস্পতিবার সকালে বাবা নেছার উদ্দিন ওই মাদ্রাসায় গিয়ে দুপুরে খাওয়ার জন্য মাইশাকে খাবার দিয়ে আসেন। পরে দুপুরে পরিবারের সবাই পলাশের ঘোড়াশালে এক আত্মীয়ের বাড়িতে দাওয়াত খেতে যান। সেখানে থাকা অবস্থায়ই বিকেল সাড়ে চারটার দিকে নেছার উদ্দিনের মুঠোফোনে মাদ্রাসার এক শিক্ষক কল করে হাসপাতালে আসতে বলেন। মুঠোফোনে ওই শিক্ষক নেছার উদ্দিনকে বলেন, ‘মাইশাকে অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে, আপনি দ্রুত নরসিংদী সদর হাসপাতালে আসেন।’ পরে নেছার উদ্দিনসহ মাইশার পরিবারের লোকজন হাসপাতালের জরুরি বিভাগে গিয়ে মাইশাকে মৃত অবস্থায় দেখতে পান। এ সময় মাইশার কপালে আঘাতের চিহ্ন দেখতে পান তাঁরা। পরে পরিবারের লোকজনকে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ জানায়, মাইশা মাদ্রাসার শৌচাগারের ভেতরে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে।

এর আগে গত ১৯ অক্টোবর একই মাদ্রাসার আরেকটি শৌচাগার থেকে আফরিন আক্তার (১৬) নামের এক ছাত্রীর লাশ উদ্ধার করা হয়েছিল।

লিখিত অভিযোগে আসামি হিসেবে সুনির্দিষ্ট কারও নাম উল্লেখ করা হয়নি। তবে অভিযোগে বলা হয়েছে, ১০ বছরের একটি শিশু কীভাবে গলায় ফাঁস নিয়ে এভাবে আত্মহত্যা করতে পারে? তাঁর মেয়েকে নির্যাতন করে মেরে ফেলা হয়েছে। মাইশাকে শ্বাসরোধ বা অন্য কোনোভাবে হত্যার পর গলায় ওড়না ও গামছা দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়। তার কপালের দুই প্রান্তে দুটি আঘাতের চিহ্নই এর প্রমাণ। মাদ্রাসারই কে বা কারা এই ঘটনা ঘটিয়েছেন।

জানতে চাইলে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মুফতি আহসানুল্লাহ বলেন, ওই ছাত্রী নিজের ওড়নার সাহায্যে শৌচাগারের ভেন্টিলেটরের রডে ঝুলে আত্মহত্যা করেছে। পরিবারের সবাই মাইশাকে রেখে এক আত্মীয়ের বাড়িতে দাওয়াত খেতে গিয়েছিলেন, বিষয়টি জানতে পেরে কষ্ট পেয়ে সে এই ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হয়েছে।

মাইশার বাবা নেছার উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাদ্রাসার ভেতরে কী হয়েছে, আমরা তো কিছুই জানি না। আত্মহত্যা বলা হলেও আঘাতের চিহ্ন দেখে আমরা ধারণা করছি, এটা অবশ্যই হত্যাকাণ্ড। তাই অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। আমার এতটুকু মেয়েকে যে বা যারা এভাবে হত্যা করেছে, পুলিশ তাদের খুঁজে বের করে শাস্তি দিক।’

আরও পড়ুন

মাধবদী থানার ওসি রকীবুজ্জামান বলেন, গতকাল রাতে মাইশার বাবা মাধবদী থানায় এসে একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। শরীরে আঘাত থাকার কারণে মাইশার পরিবার ধারণা করছে, তাকে হত্যার পর ওড়না ও গামছা দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। মধ্যরাতে লিখিত অভিযোগটি পাওয়ার পর সার্ভার সমস্যার কারণে সেটি মামলা হিসেবে নেওয়া যায়নি। আজ এটি মামলা হিসেবে নেওয়া হবে।

এদিকে মাইশা হত্যার বিচার এবং ওই মাদ্রাসা বন্ধের দাবিতে গতকাল রাতে মাদ্রাসার সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন স্থানীয় লোকজন। এ সময় শতাধিক নারী-পুরুষ হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে বিভিন্ন স্লোগান দিয়ে মাদ্রাসাটি বন্ধের দাবি জানান ও মাইশার হত্যাকারীদের ফাঁসি চান। সেখানে প্রায় এক ঘণ্টা অবস্থানের পর বিক্ষোভকারীরা একটি মিছিল নিয়ে এলাকার বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করেন।

এর আগে গত ১৯ অক্টোবর একই মাদ্রাসার আরেকটি শৌচাগার থেকে আফরিন আক্তার (১৬) নামের এক ছাত্রীর লাশ উদ্ধার করা হয়েছিল। দেড় মাসের ব্যবধানে মাদ্রাসাটির শৌচাগারের ভেতর থেকে দুই ছাত্রীর লাশ উদ্ধারের ঘটনায় এলাকায় স্থানীয় লোকজনের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। আফরিন আক্তার মাধবদীর দড়িগাজীরগাঁও এলাকার ডালিম মিয়ার মেয়ে ও মাদ্রাসাটির আলিম প্রথম বর্ষের (উচ্চমাধ্যমিক) শিক্ষার্থী ছিল।