অর্থাভাবে মেডিকেলে ভর্তি নিয়ে অনিশ্চয়তায় আরিফা

মেডিকেলে পড়াশোনার খরচ চালানো নিয়ে অনিশ্চয়তায় আরিফা আক্তার। বুধবার দুপুরে বাগেরহাট শহরের পিটিআই সড়কের পাশেছবি: প্রথম আলো

ভ্যানচালক শেখ আসাদুজ্জামানের সংসার চলে কোনোরকমে। অভাব-অনটনের মধ্যেও মেয়ে আরিফা আক্তারের পড়াশোনা চালিয়ে নিতে কখনো পিছপা হননি। মেয়ের পড়াশোনার খরচ জোগাতে সেলাইয়ের কাজ শুরু করেন আরিফার মা হামিমা আক্তার।

একপর্যায়ে নিজের সোনার গয়না বন্ধক রেখে মেয়ের পড়াশোনার খরচের জোগান দিয়েছেন তিনি। সেই মেয়ে এবার ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে মেডিকেলে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু অর্থাভাবে এখন মেডিকেলের খরচ চালানো নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছে আসাদুজ্জামান-হামিমা দম্পতি।

এই দম্পতির বাড়ি বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের প্রতাপপুর গ্রামে। মেয়ের পড়ালেখার সুবিধার্থে কয়েক বছর আগে গ্রাম ছেড়ে বাগেরহাট শহরের পিটিআই সড়কের পাশে ছোট একটি বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস শুরু করেন তাঁরা।

আরিফা ২০২২ সালে বাগেরহাট সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসিতে জিপিএ-৫ ও ২০২৪ সালে বাগেরহাট সরকারি পিসি কলেজ থেকে এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। এবার মেডিকেল কলেজ ভর্তি পরীক্ষায় ৭৮ দশমিক ৫ নম্বর পেয়ে মেধাতালিকায় ১ হাজার ৯৭১তম হয়েছেন আরিফা আক্তার। তিনি বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজে ভর্তি সুযোগ পেয়েছেন। তাঁর ছোট বোন শরিফা আক্তার ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে।

বড় মেয়ের মেডিকেলে পড়ার সুযোগ পাওয়ার বিষয়ে আক্ষেপ করে শেখ আসাদুজ্জামান বলেন, নিজে পড়ালেখা করতে পারেননি, নামটাও লিখতে পারেন না। আরিফার জন্মের জন্য যখন তাঁর মাকে হাসপাতালে নিয়েছেন, তখন তাঁর সামনে একটি কাগজ আনা হয়েছিল সই করার জন্য, কিন্তু তিনি সই করতে পারেননি। আর তখন থেকেই তিনি স্বপ্ন দেখেছেন, মেয়েকে ডাক্তার বানাবেন।

এইচএসসি পরীক্ষার পর মেডিকেল ভর্তি কোচিং করানোর মতো সামর্থ্য ছিল না আসাদুজ্জামান-হামিমা দম্পতির। তখন এনজিও ও একাধিক সমিতি থেকে ঋণ করে পড়ালেখার খরচ চালিয়েছেন তাঁরা। হামিমা আক্তার বলেন, নিজের সামান্য যা গয়না ছিল, তা বন্ধক রেখে মেয়েকে খুলনায় পড়াশোনা করিয়েছেন। এখনো প্রতি সপ্তাহে চারটি সমিতিতে সাড়ে তিন হাজার টাকা কিস্তি দিতে হয়। এরপর এখন মেডিকেল ভর্তিতে টাকা লাগবে। কীভাবে কী করবেন, বুঝতে পারছেন না।

বাবা–মা ও ছোট বোনের সঙ্গে আরিফা আক্তার (বাঁয়ে)। বুধবার দুপুরে বাগেরহাট শহরের পিটিআই সড়কের পাশে ভাড়া বাসায়
ছবি: প্রথম আলো

আসাদুজ্জামান বলেন, ‘ওর মা অনেক কষ্ট করছে। মেয়েটারও স্বপ্ন আছিল ডাক্তার হবে। আল্লাহ আমাদের কথা শুনছে, মেয়েটার সরকারি মেডিকেলে পড়ার সুযোগ হইছে। কিন্তু এখন ভর্তির যে টাকা লাগব, তা নিয়া খুব দুশ্চিন্তায় আছি।’

পরিবার জানায়, ছোটবেলায় বাড়ির পাশে একটি বিদ্যালয়ে পড়েছে আরিফা। সেখানে পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পায় সে। মেয়েটির পড়াশোনায় খুব আগ্রহ ছিল। ষষ্ঠ শ্রেণিতে বাগেরহাট সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পায়। বাড়ি থেকে প্রতিদিন বাবা ভ্যান চালিয়ে মেয়েকে প্রায় ২১ কিলোমিটার দূরে বিদ্যালয়ে নিয়ে যেতেন। অষ্টম শ্রেণিতে ভালো ফল করার পর সবাই মিলে শহরে বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস শুরু করেন।

পরিবারের ঋণের বোঝা ও পড়াশোনার খরচ চালানো নিয়ে মা-বাবার সঙ্গে নিজেও চিন্তার মধ্যে আছেন আরিফা। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ছোটবেলা থেকেই তাঁর চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন। পরীক্ষায় প্রতিবার ভালো ফল করেছেন, আর মনে হয়েছে স্বপ্নের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছেন।

আরিফা আরও বলেন, ‘আব্বু-আম্মু চেষ্টা করে গেছে। আম্মুর কিছু গয়না ছিল, সেগুলো বন্ধক দিছে, আব্বু কিছু লোন তুলছে। এখন সামনে তো ভর্তি, জানি না কী হবে, আল্লাহ তাআলা কী রাখছেন আমার কপালে।’