‘তবু ভোটটা দিতে হইব মন্দের ভালো মাইনষেরে’

নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার স্টেশন রোড এলাকার বাসিন্দা রিকশাচালক রাসেল মিয়া (৫৫) উপজেলা নির্বাচনের খবর রাখেন। কেমন প্রার্থী চান? জিজ্ঞেস করলে বলেন, ‘ভাই, গরিবের চিন্তা কেউ করে না। হুনতাছি ভোটের দিন ঝামেলা হইব। ভোটের দিন যদি ঝামেলা দেহি তাইলে ভোট দিতাম না। রিকশা চালাইয়াম। আমরার লাইগা সবাই সমান। সবাই (প্রার্থীরা) টেহা খরচ করে নিজেরা ধনী হওনের লাইগা। জনগণের জন্য কেউ ভাবে না। তবু ভোটটা দিতে হইব মন্দের ভালো মাইনষেরে।’

প্রতিপক্ষের ওপর হামলা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও নির্বাচনী কার্যালয় ভাঙচুর, অস্ত্রের মহড়া, হুমকি-মামলাসহ বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে রোববার মধ্যরাতে দ্বিতীয় ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রচার শেষ হয়েছে। রাত পোহালে নেত্রকোনার তিনটি উপজেলায় ভোট গ্রহণ শুরু হবে। ভোটাররা বলছেন, কিছু এলাকায় প্রচারণার সময়েই অনেক ঝামেলা হয়েছে। ফলে তাঁদের মনে শঙ্কা, ভোটের দিনও সংঘাত হতে পারে।

রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, পূর্বধলা, বারহাট্টা ও সদর উপজেলায় আগামীকাল মঙ্গলবার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তিন উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে ১২ জন, ভাইস চেয়ারম্যান (মহিলা ও পুরুষ) পদে ৩৫ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ৩০টি ইউনিয়নের ২৫৩টি ভোটকেন্দ্রে ৭ লাখ ৪৬ হাজার ৫৮৪ জন ভোটার তাঁদের ভোট দেবেন।

তিনটি উপজেলার ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভোটে দলীয় প্রতীকের প্রার্থী নেই। এলাকায় যার গ্রহণযোগ্যতা বেশি, সেই জিতবে। পূর্বধলা উপজেলা সদরের জামতলা এলাকার চা-বিক্রেতা রফিক মিয়া (৬৫) রোববার বিকেলে বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগই করি। কিন্তু প্রতীক ছাড়া ভোট হওয়ায় ভোট দিয়াম প্রার্থীর যোগ্যতা দেইখ্যা। যে সৎ মানুষ, সব সময় কাছে পাইয়াম, টেহা মাইরা খাইত না, তারেই আমি ভোট দিয়াম। এলা সে (পছন্দের প্রার্থী) পাস করুক আর ফেইল করুক।’

আরও পড়ুন

পূর্বধলায় চেয়ারম্যান পদে চারজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। প্রার্থীদের মধ্যে তিনজন আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেন। আর একজন বিএনপির সাবেক নেতা। প্রার্থীরা হলেন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য এ টি এম ফয়জুর সিরাজ (মোটরসাইকেল), উপজেলা যুবলীগের সাবেক আহ্বায়ক মো. মাছুদ আলম (আনারস) ও উপজেলা যুবলীগের সভাপতি মো. জাহিদুল ইসলাম (ঘোড়া প্রতীক)। আর দোয়াত-কলম প্রতীকের অপর প্রার্থী আসাদুজ্জামান উপজেলা বিএনপির সাবেক সদস্য ও তাঁতী দল কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি।

দলের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সংসদ সদস্য ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা আহমদ হোসেন সমর্থন দিচ্ছেন আসাদুজ্জামানকে। উপজেলায় বিভিন্ন সভা-সমাবেশে আসাদুজ্জামানকে পরিচয় করিয়ে তাঁকে ভোট দিয়ে বিজয়ী করার আহ্বান জানান সংসদ সদস্য। এসব কারণ দেখিয়ে গত মঙ্গলবার জাহিদুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন। তবে প্রতীক বরাদ্দের পর নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোয় ব্যালট পেপারে তাঁর নাম ও প্রতীক থেকেই যাচ্ছে।

আরও পড়ুন

জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘স্থানীয় রাজনীতিতে অস্থির পরিস্থিতি। অস্বাভাবিক টাকার খেলা। পেশিশক্তির মহড়া থেকে আমার কর্মীদের নিরাপদ রাখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা থেকে নিজেকে বিরত রাখাই সমীচীন মনে করছি।’

ফয়জুর সিরাজ আর মাছুদ আলমের দাবি, তফসিল ঘোষণার পর থেকেই সংসদ সদস্য তাঁর অনুসারীদের দিয়ে নানাভাবে হয়রানি ও নির্বাচনী প্রচারে বাধা সৃষ্টি করছেন। তাঁর পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে দলের তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের ভোট দিতে চাপ দিচ্ছেন। এতে ভোটাররা দ্বিধাবিভক্তির মধ্যে আছেন।

বারহাট্টায় প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রার্থী হলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি খায়রুল কবির (মোটরসাইকেল) ও সাধারণ সম্পাদক কাজী শাখাওয়াত হোসেন (ঘোড়া)। এ উপজেলায় সংঘাতের শঙ্কা না থাকলেও ভোটারদের উপস্থিতি নিয়ে চিন্তিত প্রার্থীরা। কারণ, এখন বোরো ধান কাটা ও রোদে শুকানোর মৌসুম চলছে। সম্প্রতি প্রথম ধাপে অনুষ্ঠিত কলমাকান্দা ও দুর্গাপুরে ভোটার উপস্থিতি প্রায় ২৮ শতাংশ।

বারহাট্টার কর্ণপুর এলাকার ভোটার রিফাত মিয়া বলেন, ‘আমাদের এলাকা কংস নদ গিলে খাচ্ছে। এখানে তেমন কোনো উন্নয়ন হয়নি। দুজন প্রার্থীই বড় নেতা। তাঁদের মধ্যেই হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। এলাকার উন্নয়নে যে বেশি কাজ করতে পারবে, যিনি আমাদের সুখে-দুঃখে থাকবেন, তাঁকেই আমরা ভোট দেব।’

সদর উপজেলার চেয়ারম্যান প্রার্থীরা হলেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মারুফ হাসান খান (হেলিকপ্টার), যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মজিবুল আলম (দোয়াত-কলম), সদস্য গোলাম মোহাম্মদ খান পাঠান (মোটরসাইকেল), বর্তমান চেয়ারম্যান উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আতাউর রহমান (কাপ-পিরিচ), সাধারণ সম্পাদক হাফিজুর রহমান খান (আনারস) ও যুবলীগ নেতা এ কে এম আজাহারুল ইসলাম (ঘোড়া)।

আরও পড়ুন

পৌরসভার সাতপাই এলাকার ভোটার আশালতা সরকার বলেন, আগে বেশ কয়েকবার ভোট দিয়েছেন। এবার প্রথম দলীয় প্রতীক ছাড়া স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি নির্বাচিত করতে হচ্ছে। ফলে মার্কা নিয়ে চিন্তা নেই। প্রার্থীর গুণাগুণ বিবেচনা করে ভোট দেবেন।

রিটার্নিং কর্মকর্তা ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. রাফিকুজ্জামান বলেন, ‘আমরা আশা করি, প্রথম ধাপের মতো দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হবে। ছোটখাটো যেসব সমস্যা মাঠে আছে, সেগুলো যাতে না হয়, সে জন্য আমরা অত্যন্ত সতর্ক রয়েছি। ভোটাররা নির্বিঘ্নে ভোট দেবেন বলে আশা করছি।’