রৌশনারা ও প্রতিভা রানী হারিয়েছেন যক্ষের ধন

কুমিল্লার দাউদকান্দিতে কাভার্ড ভ্যান ও অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত ব্যক্তিদের স্বজনদের আহাজারি।রোববার দুপুরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেছবি: প্রথম আলো

‘আমার বাবুকে আমার বুকে এনে দেও। আমার ছেলেকে ছাড়া আমি কী নিয়ে বাঁচব? ওর ভাইবোনের দায়িত্ব এখন কে নেবে?’ সড়ক দুর্ঘটনায় উপার্জনক্ষম একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এভাবে বিলাপ করছিলেন মা প্রতিভা রানী মন্ডল।

পাশেই আহাজারি করছিলেন আরেক মা রৌশনারা বেগম। তিনিও একমাত্র উপার্জনকারী ছেলেকে হারিয়েছেন। কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, ‘ছেলে মারা যাওয়ায় এখন তার সন্তানদের (নাতি) কী হবে? কে তাদের খাওয়াবে? কে লেখাপড়ার খরচ দেবে?’

রোববার সকালে দাউদকান্দির মহানন্দে ঢাকা-আমিরাবাদ-কচুয়া সড়কে কাভার্ড ভ্যান ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে নিজেদের একমাত্র অবলম্বন হারিয়েছেন প্রতিভা রানী মন্ডল ও রৌশনারা বেগম। দুর্ঘটনায় তাঁদের ছেলে পীযূষ কুমার মন্ডল ও ইসমাইল হোসেনসহ পাঁচজন নিহত হয়েছেন। তাঁদের কেউ মা-ছেলে, কেউবা ভাই, আবার কেউ পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি ছিলেন। দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত দুজনকে ইতিমধ্যে কুমিল্লা থেকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।

সড়ক দুর্ঘটনায় উপার্জনক্ষম একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে দিশেহারা মা রৌশনারা বেগম। রোববার দুপুরে দাউদকান্দি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে
ছবি: প্রথম আলো

নিহত পাঁচজন হলেন অটোরিকশাচালক দাউদকান্দির দরদখোলা গ্রামের মো. ইসমাইল হোসেন (৩০), পল্লী সঞ্চয় প্রকল্পের মাঠ কর্মকর্তা দক্ষিণনগর গ্রামের পীযূষ কুমার মন্ডল (৩১), বায়নগর কওমি মাদ্রাসার ছাত্র আনুয়াখোলা গ্রামের মো. শফিউল্লাহ (২৩), শফিউল্লাহর মা জাহানারা বেগম (৬৫) ও দক্ষিণনগর গ্রামের বাসিন্দা মো. মনিরুজ্জামান (৩৫)। আহত দুজন হলেন দাউদকান্দির আঙ্গাউড়া গ্রামের বাসিন্দা সাদিয়া (২০) ও শরীফ (৫)।

১৬ বছর আগে সৌদি আরবে এক সড়ক দুর্ঘটনায় স্বামী চিত্তরঞ্জন মন্ডলকে হারান প্রতিভা রানী মন্ডল। তিন ছেলে ও এক মেয়ের পড়ালেখা ও সংসার চালাতে গ্রাম পুলিশের চাকরি নেন। খেয়ে না খেয়ে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখান। বড় ছেলে পীযূষ হিসাববিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর শেষ করে পাঁচ বছর আগে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকে মাঠ সহকারীর চাকরি নেন। এরপর হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন প্রতিভা রানী। ভাইদের পড়ালেখা ও ছোট বোনের বিয়ে দেবেন, এমন স্বপ্ন ছিল। কিন্তু দুর্ঘটনা যেন সব কেড়ে নিল।

নিহত পীযূষের ভাইবোনেরা সবাই এখনো অধ্যয়নরত। ছোট ভাই প্রীতম কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজে দর্শন বিষয়ে স্নাতকোত্তর করছেন। আরেক ভাই লিটন হাজিগঞ্জ মডেল সরকারি কলেজে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে স্নাতকে পড়ছেন। একমাত্র বোন উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্রী। বড় ভাইয়ের শোকে কাঁদতে কাঁদতে দুই ভাইয়ের চোখের জল যেন শুকিয়ে গেছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স মাঠে দুজন নির্বাক বসে আছেন। স্বজন ও পীযূষের সহকর্মীরা তাঁদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।

সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালিয়ে স্ত্রী-সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিতেন দরদখোলা গ্রামের অহিদ মিয়ার ছেলে ইসমাইল হোসেন। দুর্ঘটনায় ইসমাইলের মারা যাওয়ার খবর শুনে পুত্রবধূ-নাতিদের নিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ছুটে আসেন মা রৌশনারা বেগম। নিহত ইসমাইলের বড় মেয়ে দশম শ্রেণিতে ও ছোট ছেলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ছে। নিহত ব্যক্তির স্ত্রী ইয়াছমিন আক্তার আহাজারি করতে করতে বলেন, ‘ছেলেমেয়েদের নিয়ে আমি এখন কী করব?’ ইসমাইলের প্রতিবেশী হাবিবুর রহমান বলেন, পরিবারটি ইসমাইলের আয়ের ওপর নির্ভরশীল ছিল।

মুখোমুখি সংঘর্ষে দুমড়েমুচড়ে যাওয়া অটোরিকশাটি কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার গৌরীপুর পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রে রাখা হয়েছে। রোববার দুপুরে
ছবি: প্রথম আলো

দুর্ঘটনায় নিহত মো. শফিউল্লাহ কোরআনের হাফেজ ছিলেন। পাঁচ ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সবার ছোট। কওমি মাদ্রাসায় পড়াশোনার পাশাপাশি মসজিদে ইমামতি করতেন। অসুস্থ মা জাহানারা বেগমকে চিকিৎসক দেখানোর জন্য অটোরিকশায় উপজেলা হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিলেন। পথে দুর্ঘটনায় মা-ছেলে দুজনই নিহত হন। মা-ভাইয়ের মৃত্যুর খবর শুনে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ছুটে আসেন বড় বোন রহিমা আক্তার ও সেলিনা আক্তার। আদরের ভাইকে হারিয়ে তাঁদের আহাজারি থামছেই না।

কাভার্ড ভ্যান ও অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত মনিরুজ্জামান উপজেলার মালিগাঁও ইউনিয়নের দক্ষিণনগর গ্রামের রুহুল আমিনের ছেলে। স্থানীয় গৌরীপুর ন্যাশনাল লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি কার্যালয়ের কর্মকর্তা ছিলেন। সকালে বাড়ি থেকে বের হয়ে কর্মস্থলে যাওয়ার পথে মারা যান। মালিগাঁও ইউপির ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মনিরুজ্জামানের পরিবারে মা-বাবা, তিন বোন, স্ত্রী ও তিন সন্তান আছে। তিনি পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ছিলেন। মনিরুজ্জামানের মৃত্যুতে পরিবারটি অসহায় হয়ে পড়ল।

দাউদকান্দি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মোজাম্মেল হক বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, স্বজনদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ময়নাতদন্ত ছাড়াই সুরতহাল শেষে লাশগুলো হস্তান্তর করা হয়েছে। স্বজনদের মামলা করার কথা বলা হবে। তাঁরা মামলা করতে না চাইলে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করবে। তিনি বলেন, কীভাবে দুর্ঘটনা ঘটল, পুলিশ তদন্ত করছে। দুর্ঘটনাকবলিত গাড়ি দুটি জব্দ করে দাউদকান্দির গৌরীপুর পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রে রাখা হয়েছে।

আরও পড়ুন