ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে ঝুঁকিপূর্ণ ১১টি বাঁক, নির্বিঘ্ন ঈদযাত্রা নিয়ে শঙ্কা
স্বাভাবিক সময়ে বরিশাল থেকে ঢাকায় তিন শতাধিক বাস চলাচল করে। কিন্তু ঈদ সামনে রেখে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে যানবাহনের সংখ্যা কয়েক গুণ বেড়ে যায়। মহাসড়কের ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে বরিশাল হয়ে কুয়াকাটা পর্যন্ত ২০৫ কিলোমিটার সড়ক অপ্রশস্ত। এ ছাড়া অসংখ্য বাজার ও ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক থাকায় প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা। এমন পরিস্থিতিতে নির্বিঘ্ন ঈদযাত্রা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ইতিমধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করে যানজট নিরসনে ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। খোলা হচ্ছে তিনটি কন্ট্রোল রুম।
বরিশালের পুলিশ সুপার ওয়াহিদুল ইসলাম বলেন, যানজট নিরসনে ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে অতিরিক্ত ১৫০ জনকে আলাদা দায়িত্ব দিয়েছেন। ১১টি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা নির্ধারণ করে বিশেষ ব্যবস্থাও নিচ্ছেন।
বরিশাল বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কিশোর কুমার দে প্রথম আলোকে বলেন, ভাঙ্গার পর সড়ক খুবই সরু। সড়কে ধারণক্ষমতার কয়েক গুণ গাড়ি চলাচল করে। পদ্মা সেতু চালুর আগে বরিশাল থেকে দেড় শ বাস চলাচল করত, সেতু চালুর পর তিন শ ছাড়িয়েছে। ঈদের সময় আরও বাড়বে। এখন পরিবহনগুলো দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করে। এতে যানজটের পাশাপাশি দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
সরু সড়কে অসংখ্য বাজার
সড়ক ও জনপথ (সওজ) বলছে, ঢাকা থেকে বরিশাল হয়ে কুয়াকাটার দূরত্ব ২৯৩ দশমিক ৭ কিলোমিটার। এর মধ্যে ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত ২০৫ কিলোমিটার সড়ক মাত্র ২৪ ফুট চওড়া। এ মহাসড়ক ঢাকা থেকে বরিশাল বিভাগের ১০ জেলার যানবাহন সামাল দিতে হিমশিম অবস্থা। পদ্মা সেতু চালুর পর পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে। ঈদ সামনে রেখে ঝুঁকি আরও বেড়েছে।
সূত্র জানায়, বরিশাল থেকে ফরিদপুরের ভুরঘাটা পর্যন্ত ৪৬ কিলোমিটারে ১৮টি ও বরিশাল জিরো পয়েন্ট থেকে বাকেরগঞ্জ পর্যন্ত ১৮ কিলোমিটারে ৭টি ও বাকেরগঞ্জ থেকে পটুয়াখালী পর্যন্ত ২৫ কিলোমিটারে অন্তত ১০টি বাজার আছে। মহাসড়কের পাশে ভাসমান এসব বাজারে বাস, রিকশা ও টেম্পোস্ট্যান্ড আছে। বাজারে ঢোকার মুখে বাসস্ট্যান্ডে রিকশা, ভ্যান যাত্রী ওঠানামা করায় দূরপাল্লার বাস সড়কে আটকা পড়ে।
সরেজমিনে বরিশাল থেকে বাকেরগঞ্জ পর্যন্ত ১৮ কিলোমিটার মহাসড়কে অন্তত সাতটি স্থায়ী বাজার দেখা গেছে। এর মধ্যে নগরের রূপাতলী বাসস্ট্যান্ড এলাকা, জিরো পয়েন্ট, বুড়িরহাট, খেজুরতলা, শিমুলতলা, আউলিয়াপুর, বোয়ালিয়া, বাকেরগঞ্জ অন্যতম। বাকেরগঞ্জের বাসিন্দা বশির উদ্দীন বলেন, বোয়ালিয়া এলাকায় মহাসড়কের পাশে সপ্তাহে দুই দিন বাজার বসে। এতে যানজট ও দুর্ঘটনা লেগেই থাকে।
বাকেরগঞ্জের পর পটুয়াখালী পর্যন্ত ২৫ কিলোমিটারে মহাসড়কের পাশে অন্তত ১০টি বাজার বসে। এর মধ্যে সিনেমা হল বাজার, বটতলা, লক্ষ্মীপাশা, দাদুরহাট, লেবুখালী, পাগলা, মৌকরণ, তেলিয়াখালী, লাউকাঠি ও পটুয়াখালী অন্যতম। বাসচালক আবদুস সালাম বলেন, ‘মহাসড়কে বাস চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। বাজার আর অবৈধ যান চলাচল করায় আমরা ঠিকমতো গাড়ি চালাতে পারি না। এসব বাজার নির্দিষ্ট স্থানে সরিয়ে নিলে দুর্ঘটনা কমে যেত।’
এ বিষয়ে বরিশাল সওজের আঞ্চলিক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী এ কে এম আজাদ রহমান ও নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুদ মাহমুদের সঙ্গে কথা বলতে একাধিকবার ফোন করা হলেও তাঁরা সাড়া দেননি।
ঝুঁকিপূর্ণ ১১টি বাঁক
ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের বরিশাল অংশে উজিরপুরের জয়শ্রী বাজার মোড় থেকে সাজু ফিলিং স্টেশন মোড়, আঁটিপাড়া মোড়, মুণ্ডপাশা মোড়, নতুন শিকারপুর মোড়, সোনার বাংলা স্কুল মোড়, মেজর এম এ জলিল সেতুর ঢালের মোড়, রাকুদিয়া নতুন হাট মোড়, ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন সেতু-সংলগ্ন মোড় সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এসব বাঁকে প্রায় প্রতিদিনই ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটে।
সওজ সূত্র জানায়, বরিশালের নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে বাবুগঞ্জ উপজেলার দোয়ারিকা এলাকায় সুগন্ধা নদীর ওপর বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সেতু। এরপর দুই কিলোমিটার সামনেই ইচলাদী এলাকায় সন্ধ্যা নদীর ওপরে মেজর এম এ জলিল (শিকারপুর) সেতু। ২০০৩ সালে সেতু দুটি নির্মাণের আগে ফেরি পারাপার করা হতো। সেতু দুটি ঘিরে বরিশাল বিমানবন্দর মোড় থেকে উজিরপুরের জয়শ্রী বাজার পর্যন্ত ছয় কিলোমিটার সংযোগ সড়ক নির্মিত হয়। ওই বাঁকগুলো মহাসড়কের ওই অংশে পড়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রশস্ত ও মসৃণ সড়ক অতিক্রমের সময় যানবাহনের গতিসীমা সর্বোচ্চ ৬০ কিলোমিটার লেখা থাকলেও চালকেরা মানছেন না। বেশির ভাগ যানবাহনকে ৮০ কিলোমিটার গতিসীমার ওপরে চলাচল করতে দেখা যায়। যাত্রীরা জানান, মহাসড়কের এই ছয় কিলোমিটারে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে।
বাসচালক হাবিবুর রহমান বলেন, ভাঙ্গার পর কুয়াকাটা পর্যন্ত সড়ক মাত্র ২৪ ফুট প্রশস্ত। সড়কের পাশে অসংখ্য বাজার বসে। তিন চাকার যান চলাচল করে। আছে অসংখ্য বাঁক। পদ্মা সেতু চালুর পর যানবাহন তিন-চার গুণ বেড়েছে। সড়কে যানজটসহ নানা ঝামেলা লেগেই থাকে। সঠিক সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে না পারায় অধিকাংশ সময় গাড়ির ওপর থাকতে হয়। ঈদের সময় পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে যায়। গাড়ির ফিটনেস, বেপরোয়া গতি ও সরু সড়কের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে।
মহাসড়কের গৌরনদী থেকে বাবুগঞ্জ পর্যন্ত এলাকাটি খুবই দুর্ঘটনাপ্রবণ। প্রায় প্রতিদিনই ছোট-বড় দুর্ঘটনায় প্রাণহানি হচ্ছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সেখানে ১০টি দুর্ঘটনায় ১৬ জনের প্রাণহানি হয়েছে। যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্যমতে গত বছর বরিশাল বিভাগে ৩৮১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৭৯ জন নিহত, ৯৯২ জন আহত হয়েছেন।
গৌরনদী হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গোলাম রসুল মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, চলতি বছরে ১২টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। তবে হতাহতের পরিমাণ নথিপত্র না দেখে বলা যাবে না।
পুলিশের নানা উদ্যোগ
পুলিশ বলছে, ঈদের আগে–পরে বরিশালের নথুল্লাবাদ, সাগরদী, রূপাতলীসহ জেলার গৌরনদী, বাটাজোর, টরকি, ইচলাদি মিলিয়ে ১১টি পয়েন্ট দিয়ে প্রতিদিন অন্তত ২৫ হাজার যানবাহন অতিক্রম করবে। এর মধ্যে তিন জায়গায় সেতুর টোলঘর আছে। ঝুঁকিপূর্ণ এসব এলাকা চিহ্নিত করে ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হবে। একইভাবে নগরের নথুল্লাবাদ, রূপাতলী বাসস্ট্যান্ড ও নদীবন্দরে তিনটি কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। মহাসড়ক ঘেঁষে থাকা বাজারগুলোও নজরদারির উদ্যোগ নেবে পুলিশ।
বরিশাল মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. জিহাদুল কবির প্রথম আলোকে বলেন, ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে সড়ক ও নৌপথে তাঁরা বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছেন। পুলিশের সব ইউনিট সমন্বিতভাবে কাজ করবে। দুটি বাসস্ট্যান্ড ও নদীবন্দরে তিনটি কন্ট্রোল রুম খুলেছেন। আশা করছেন এবার ঘরমুখী যাত্রীরা নির্বিঘ্নে বাড়িতে ফিরতে পারবেন।