ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক যে কারণে এখন মৃত্যুকূপ

মহাসড়কে এভার টেকিং নিষিদ্ধ হলেও এমন চিত্র নিয়মিতই চোখে পড়েছবি: দীপু মালাকার

ঢাকা থেকে সড়কপথে বরগুনার পাথরঘাটার দূরত্ব ৩৩৪ কিলোমিটার। পদ্মা সেতু চালুর আগে এ পথে দৈনিক বাস চলত ২০টি। তবে এখন চলে ৫০টির বেশি। আগে ফেরি পার হয়ে গন্তব্যে যেতে ১২-১৩ ঘণ্টা সময় লাগত। কিন্তু এখন লাগে ৬ ঘণ্টা। দীর্ঘপথ পাড়ি দেওয়ার পর পূর্ণাঙ্গ বিশ্রামের আগেই চালকদের আবার যাত্রী নিয়ে গন্তব্যে ছুটতে হয়। চালকেরা পর্যাপ্ত বিশ্রাম না নিয়ে গাড়ি চালানোর কারণে মহাসড়কে দুর্ঘটনা বেড়েছে। শুধু পাথরঘাটা নয়, দক্ষিণাঞ্চলের সব রুটের চালকদের একই অবস্থা।

১৯ মার্চ পদ্মা সেতুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক্সপ্রেসওয়েতে সড়ক দুর্ঘটনায় ১৯ জনের প্রাণহানি ঘটে। খুলনা থেকে আসা ইমাদ পরিবহন নামের একটি বাস শিবচরের কুতুবপুর এলাকায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে যায়। ওই দুর্ঘটনার পেছনেও চালকের বিশ্রামহীনতা অন্যতম কারণ ছিল বলে নিশ্চিত করেছে মাদারীপুর জেলা প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটি।

তদন্ত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাসটি অতিরিক্ত গতিতে চলছিল। সর্বোচ্চ গতি ছিল ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটারের বেশি। পর্যাপ্ত বিশ্রামের আগে বাস চালানোর কারণে চালক ক্লান্ত ছিলেন। ঘুম ঘুম ভাব ও অতিরিক্ত গতির কারণেই বাসটির নিয়ন্ত্রণ হারান চালক।

আরও পড়ুন

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন চালক বলেন, ঢাকা থেকে সন্ধ্যায় রওনা দিয়ে পাথরঘাটায় পৌঁছাতে রাত ১২টা বা ১টা বাজে। এরপর যাত্রী নামিয়ে বাস পরিষ্কার করতে এক-দেড় ঘণ্টা সময় লাগে। ভোর সাড়ে পাঁচটায় যাত্রী নিয়ে আবার ঢাকায় ফিরতে হয়। বাসের মধ্যে তাঁরা দেড়-দুই ঘণ্টা ঘুমানোর সুযোগ পান। এ অবস্থায় বাস চালালে মনোযোগ ধরে রাখা কঠিন হয়। শরীর ক্লান্ত ও মেজাজ বিগড়ে থাকে। এ জন্য দুর্ঘটনা ঘটে। মালিকপক্ষকে বিষয়টি বললেও তাঁরা বুঝতে চান না। মালিকপক্ষ যেভাবেই হোক ট্রিপ ঠিক রেখে গাড়ি চালাতে বলেন।

রাহাত হোসেন নামের এক যাত্রী বলেন, অধিকাংশ বাস নির্ধারিত সময়ের পর স্টেশন ত্যাগ করে। পথে বিভিন্ন কাউন্টার থেকে যাত্রী তোলে। এরপর নির্ধারিত সময়ের মধ্যে গন্তব্যে যাওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকায় চালকেরা মানসিক চাপে থাকেন। বেপরোয়া গতিতে বাস চালাতে বাধ্য হন। এ কারণে সড়কে দুর্ঘটনা বাড়ছে।

মহাসড়কে মৃত্যুর মিছিল

পদ্মা সেতু চালুর পর রাজধানীর সঙ্গে বরিশালসহ দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলাগুলোর যোগাযোগ মসৃণ হলেও মহাসড়কে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি বেড়েছে। ১৭ মার্চ পিরোজপুরসহ বরিশাল বিভাগের ৩ জেলায় এক দিনে সড়কে প্রাণ হারান ১০ জন। ২০২২ সালের ২৯ মে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের উজিরপুর উপজেলায় বাসের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ১১ যাত্রীর মৃত্যু হয়। ওই বছরের জুলাই মাসে বাকেরগঞ্জে বিআরটিসির বাসের ধাক্কায় ইজিবাইকের চালকসহ ৬ যাত্রী এবং উজিরপুরের শিকারপুরে বাসের ধাক্কায় পর্যটকবাহী মাইক্রোবাসের ৬ যাত্রী নিহত হন।

সুশাসনের জন্য নাগরিক—সুজনের বরিশাল মহানগরের সভাপতি অধ্যক্ষ মোতালেব হাওলাদার বলেন, ‘পদ্মা সেতু আমাদের যোগাযোগে অভূতপূর্ব উন্নয়ন ঘটিয়েছে। তবে এর সুফল পেতে হলে সড়ক পরিকাঠামো আধুনিকায়ন ও গণপরিবহনব্যবস্থাকে আইনি কাঠামোর মধ্যে আনতে হবে। অন্যথায় মৃত্যুর মিছিল রোধ করা সম্ভব হবে না।’

খুলনা থেকে ছেড়ে আসা ইমাদ পরিবহনের বাসটি পদ্মা সেতুতে ওঠার আগে চালক নিয়ন্ত্রণ হারালে ছিটকে পড়ে বাসটি দুমড়েমুচড়ে যায়
ফাইল ছবি

বাসচালক হাবিবুর রহমান বলেন, সড়কে যানজটসহ নানা ঝামেলা থাকে। সঠিক সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে না পারায় অধিকাংশ সময় তাঁদের গাড়ির ওপর থাকতে হয়। ঈদের সময় পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়। একদিকে যাত্রীদের চাপ, অন্যদিকে মালিকপক্ষের চাপ। তাঁদেরও বাড়তি রোজগারের চেষ্টা থাকে। পাশাপাশি গাড়ির ফিটনেস, বেপরোয়া গতি ও সরু সড়কের কারণেও দুর্ঘটনা ঘটে।

তবে বরিশাল বাস মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক কিশোর কুমার দে বলেন, চালকদের বিশ্রাম না নেওয়ার প্রবণতা উত্তরাঞ্চলে বেশি। দক্ষিণাঞ্চলে নেই বললেই চলে। তাঁদের সমস্যা হলো সড়কের পাশে বাজার ও তিন চাকার যান। এ ছাড়া যাত্রীরা কম গতিতে বাস চালালে চালকদের গালমন্দ করেন। এতে চালকেরা মেজাজ হারিয়ে দ্রুতগতিতে বাস চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনার কবলে পড়েন।

বরিশালের পরিবহন খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বরিশালের নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে প্রতিদিন ঢাকা, বেনাপোল, খুলনাসহ বিভিন্ন রুটে ২৪০টির বেশি বাস চলাচল করে। অভ্যন্তরীণ ৬টি রুটে চলে আরও ১৮০টি বাস। অন্যদিকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৬ জেলার মালিক সমিতির সমন্বয়ে গঠিত রূপাতলী বাস টার্মিনাল থেকে দক্ষিণাঞ্চলের ১৯টি রুটে চলে পাঁচ শতাধিক মিনিবাস। দুটি টার্মিনাল থেকে প্রতিদিন দুই লাখের বেশি যাত্রী যাতায়াত করেন। অথচ বাস চলাচলে প্রশাসনের তেমন নিয়ন্ত্রণ ও রূপরেখা নেই। ফলে পরিবহনমালিক-শ্রমিকদের খেয়ালখুশিমতো এসব বাস চলাচল করছে।

চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পদ্মা সেতু চালুর পর বরিশাল থেকে ঢাকার দূরত্ব ১৬০ কিলোমিটার। একজন চালক দূরপাল্লাসহ গড়ে প্রতিদিন ২৫০ কিলোমিটার গাড়ি চালান। ঢাকা থেকে বরিশাল আসা-যাওয়ায় বাসপ্রতি ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা মজুরি পান। বরিশাল থেকে খুলনায় প্রতি ট্রিপে ৬০০ থেকে ৮০০, বরিশাল থেকে বেনাপোলে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা মজুরি পান তাঁরা।

দুর্ঘটনার হিসাবে গরমিল

সরকারিভাবে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের হিসাব রাখা হলেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তথ্যের ব্যাপক গরমিল আছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ের তথ্যমতে, গত বছর বরিশাল বিভাগের ৬ জেলায় ৬৯টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ৮৮ জন নিহত ও ২০৫ জন আহত হন। তবে সড়কের নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান নিরাপদ সড়ক চাই—নিসচার প্রতিবেদন বলছে, ২০২২ সালে বরিশাল বিভাগে ৩৮২টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে ৩৯৮ জন নিহত ও ৮৮৫ জন আহত হয়েছেন।

দুর্ঘটনা–কবলিত অ্যাম্বুলেন্স
ফাইল ছবি
আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

কেন এত দুর্ঘটনা

নিসচার প্রতিবেদনে সড়ক দুর্ঘটনার ১১১টি কারণ তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে চালকদের গতির প্রতিযোগিতা, দৈনিক চুক্তিতে গাড়ি চালানো, পথচারীদের সচেতনতার অভাব, ওভারটেকিং, দীর্ঘক্ষণ টানা গাড়ি চালানো, সড়ক-মহাসড়কে মোটরসাইকেল ও তিন চাকার গাড়ির আধিক্য, মহাসড়ক নির্মাণত্রুটি, রাস্তার পাশে হাটবাজার, অশিক্ষিত ও অদক্ষ চালক, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব, সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়ন না হওয়া ইত্যাদি।

তবে দুর্ঘটনার পেছনে চালকদেরই দায়ী করেছেন বিআরটিএর বরিশাল বিভাগীয় পরিচালক জিয়াউর রহমান। তিনি বলেন, দুর্ঘটনা রোধে বিআরটিএ থেকে চালকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হলেও বাস্তবে তাঁরা নিয়ম মেনে গাড়ি চালান না। আইন অনুযায়ী একজন চালকের ২৪ ঘণ্টায় ৮ ঘণ্টা গাড়ি চালানোর কথা। এর মধ্যে টানা ৫ ঘণ্টা গাড়ি চালানোর পর আধা ঘণ্টা বিশ্রাম নেওয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু চালকেরা এর তোয়াক্কা করছেন না। তিনি বলেন, ‘এ নিয়ে বাসমালিকদেরও আমরা সচেতন করেছি। কিন্তু মালিকদের চেয়ে চালকদের দায়ভার বেশি। কারণ, বাসটি তিনি চালান। যাত্রীদের নিরাপত্তা তাঁকেই নিশ্চিত করতে হবে।’