অসুস্থ মদনটাককে মোটরসাইকেলে নিয়ে যাওয়া হলো হাসপাতালে

মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার লাঠিটিলা-ডোমাবাড়ি এলাকা থেকে বুধবার দুপুরে মদনটাক পাখিটি উদ্ধার করেন দুই তরুণ
ছবি: প্রথম আলো

ধানখেতে পড়ে থাকা বড় আকারের পাখিটি পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু বারবার ব্যর্থ হচ্ছিল। একপর্যায়ে এক তরুণের চোখে পড়ে দৃশ্যটি। তিনি ছুটে গিয়ে পাখিটি উদ্ধার করে আনেন। পরে আরেক তরুণের সহযোগিতায় পাখিটি মোটরসাইকেলে করে উপজেলা প্রাণিসম্পদ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসার পর পাখিটি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে।

আহত পাখিটি ছিল বিপন্ন প্রজাতির মদনটাক। বুধবার দুপুরে মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার গোয়ালবাড়ী ইউনিয়নের বাংলাদেশ–ভারত সীমান্তবর্তী লাঠিটিলা-ডোমাবাড়ি এলাকায় পাখিটি পাওয়া যায়। লাঠিটিলা-ডোমাবাড়ি গ্রামের পাশেই লাঠিটিলা সংরক্ষিত বন ও কয়েকটি চা-বাগান রয়েছে।

বেলা দুইটার দিকে উপজেলা সদরের বাছিরপুর এলাকায় প্রাণিসম্পদ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, টেবিলের ওপর দুই তরুণ মদনটাক পাখিটি ধরে রেখেছেন। এটির লম্বা ঠোঁট। ওজন প্রায় পাঁচ কেজি। চিকিৎসকেরা এটির চিকিৎসা নিয়ে ব্যস্ত। পাখিটি উদ্ধার করে আনেন খোরশেদ আলম ও কামাল আহমদ। তাঁদের বাড়ি লাঠিটিলা-ডোমাবাড়ি গ্রামে। তাঁরা ‘পাথারিয়া বন্য প্রাণী টিম’ নামের স্থানীয় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্য।

কামাল আহমদ বললেন, দুপুরের দিকে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় রোপা আমন ধানের খেতে মদনটাকটি পড়ে থাকতে দেখেন। দ্রুত ছুটে যান সেখানে। পাখিটি দুই পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ানোর জন্য বারবার চেষ্টা চালাচ্ছিল। কোনোভাবেই পারছিল না। তখন বুঝতে পারেন পাখিটি অসুস্থ। এরপর মুঠোফোনে প্রতিবেশী তরুণ খোরশেদ আলমকে ঘটনাটি জানান। পরে দুজনে পাখিটি ধরে গামছা দিয়ে মুড়িয়ে মোটরসাইকেলে করে ২৩ কিলোমিটার দূরে প্রাণিসম্পদ হাসপাতালে নিয়ে আসেন।

কামাল আরও বললেন, দুটি মদনটাক পাখিকে এলাকায় প্রায়ই দেখা যায়। ধান পাকার সময় তারা খেতে খাবার খুঁজতে বের হয়। পাখি দুটি লাঠিটিলা বনে অথবা আশপাশের কোনো চা-বাগানে থাকে।

প্রাণিসম্পদ হাসপাতালের ভেটেরিনারি সার্জন মৃদুল কান্তি দে বলেন, পাখিটি খুবই দুর্বল। কোনো খাবার খেতে চাচ্ছে না। এটির শরীরের তাপমাত্রা ১০৫ থেকে ১০৭ ডিগ্রি থাকার কথা। কিন্তু এর শরীরের তাপমাত্রা ৯৭ ডিগ্রি পাওয়া গেছে। ডেক্সট্রোজ স্যালাইন দেওয়ার পর একটু সুস্থ হয়ে ওঠে। তবে পাখিটির শরীরের কোনো স্থানে ক্ষত দেখা যায়নি।

আরও পড়ুন

চিকিৎসক আরও বলেন, চিকিৎসা করে পাখিটির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপত্র দেওয়া হয়েছে। ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী ওষুধ ব্যবহার করতে হবে। দু-তিন দিন পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। অবস্থার উন্নতি না হলে মৌলভীবাজার জেলা সদরের প্রাণিসম্পদ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

পাখি উদ্ধারকারী আরেক তরুণ খোরশেদ আলম বলেন, ‘আগের থেকে পাখিটাকে কিছুটা সুস্থ লাগছে। প্রথমে দাঁড়াতেই পারেনি। এখন উঠে দাঁড়াতে পারছে। পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠলে বন্য প্রাণী বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এটিকে ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে কথা বলব।’

ভিডিও কলে পাখিটিকে দেখে পাখি–বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ইনাম আল হক বলেন, মদনটাক বিপন্ন ও দুর্লভ প্রজাতির পাখি। সারা বিশ্বে এটি বিপন্ন। আগে দেশের বিভিন্ন চা-বাগানে দু-একটির দেখা মিলত। এখন আর তেমন দেখা যায় না। দেশের সুন্দরবনে কিছু মদনটাকের দেখা মেলে। উত্তরবঙ্গের কয়েকটি স্থানে দু-একটি দেখা যায়। সুন্দরবনের শ্বাসমূলীয় বনে এ পাখি বাসা বেঁধে থাকে। সারা দেশে এখন ৫০ জোড়ার বেশি মদনটাক মিলবে না বলে তিনি জানান। মদনটাকের শরীর বড় হওয়ায় খাবার শিকার করতে পারে না। তারা কাদামাটির ভেতর লম্বা ঠোঁট ঢুকিয়ে মরা-পচা মাছ ও ছোট প্রাণী খেয়ে থাকে। মূলত খাবারের সংকটের কারণে এ পাখি বিপন্ন হয়ে গেছে। মদনটাক সাধারণত ৩০-৪০ বছর বাঁচে। তবে এখন খাবারের সংকটে ১৫-২০ বছরও বাঁচে না।

আরও পড়ুন

ইনাম আল হক আরও বলেন, উদ্ধার করা মদনটাকটি নিরিবিলি স্থানে পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। মানুষের হইচই–কোলাহলে পাখিটি বিরক্ত হতে পারে। পুরো সুস্থ হওয়ার পর এটিকে বনে ছেড়ে দেওয়া যাবে। পাখিটি রক্ষায় তরুণদের উদ্যোগের প্রশংসা করেন তিনি।

বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের মৌলভীবাজার কার্যালয়ের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম মুঠোফোনে জানান, মদনটাক উদ্ধারের তথ্য তাঁরা পেয়েছেন। ইতিমধ্যে উদ্ধারকারী তরুণদের সঙ্গে তাঁদের কথা হয়েছে। পাখিটির সেবাশুশ্রূষা করতে তরুণেরা আগ্রহ জানিয়েছেন। তাই পাখিটি সেখানে রেখে পরিচর্যা করা হবে। তাঁদের পক্ষ থেকেও নিয়মিত খোঁজখবর নেওয়া হবে। দু-এক দিন পর্যবেক্ষণে রেখে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।