টেকনাফের ওপারে গ্রেনেড-মর্টার শেল বিস্ফোরণ, আতঙ্কে নির্ঘুম রাত

মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে রাখাইন-রোহিঙ্গা সংঘাত চলছেই। ছবি: গুগল ম্যাপ।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে গতকাল সোমবার রাতেও গোলাগুলি, গ্রেনেড-বোমা ও মর্টার শেলের বিস্ফোরণ হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যা সাতটা থেকে আজ মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত সেখানকার কুমিরখালী, বলিবাজার, নাইচাডং, কোয়াচিদং, শিলখালী, কেয়ারিপ্রাং, পেরাংপ্রু এলাকায় বিকট শব্দে শক্তিশালী বিস্ফোরণে টেকনাফ সীমান্ত কেঁপে ওঠে। আতঙ্কে ছোটাছুটি করেন টেকনাফ পৌর শহর, সাবরাং, হ্নীলা, হোয়াইক্যং ইউনিয়নের মানুষ; নির্ঘুম রাত কাটে তাঁদের।

টানা এক মাসের বেশি সময় ধরে রাখাইন রাজ্যে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে সংঘাতে জড়ায় দেশটির স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি (এএ)। সীমান্তের একাধিক সূত্র জানায়, আরাকান আর্মিকে লক্ষ্য করে কয়েক দিন ধরে আকাশ থেকে শক্তিশালী গ্রেনেড-বোমা, মর্টার শেল নিক্ষেপ করছে সরকারি বাহিনী। স্থল থেকে পাল্টা গুলি ছুড়ে জবাব দিচ্ছে আরাকান আর্মি। দুই পক্ষের তুমুল লড়াই এবং শক্তিশালী গ্রেনেড-বোমা ও মর্টার শেলের আঘাতে লন্ডভন্ড হয়ে পড়েছে মংডু দক্ষিণাংশের যোগাযোগব্যবস্থা। স্থলপথে মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর টহল সীমিত হয়ে পড়েছে। এ সুযোগে আরাকান আর্মি মংডু টাউনশিপের নিয়ন্ত্রণ নিতে অগ্রসর হচ্ছে। কিন্তু খাদ্য ও জ্বালানি–সংকট দুই পক্ষকে ভোগাচ্ছে।

আরও পড়ুন

টেকনাফ স্থলবন্দরে পণ্য নিয়ে আসা মিয়ানমারের কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, মংডু শহর থেকে উত্তর দিকে তুমব্রু পর্যন্ত (বাংলাদেশের ঘুমঘুম সীমান্তের বিপরীতে) অন্তত ৪৭ কিলোমিটারের আরাকান সড়কে ছোট–বড় ১২টি সেতু রয়েছে। গভীর রাতে আকাশ থেকে নিক্ষেপ করা মর্টার শেলের আঘাতে ইতিমধ্যে সাতটির বেশি সেতু ভেঙে পড়েছে, সড়কের বিভিন্ন অংশও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে মংডু শহরের সঙ্গে তুমব্রু পর্যন্ত সড়কটিতে সরাসরি যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। সরকারি বাহিনীর টহল ও সাঁজোয়া যানের চলাচল বাধাগ্রস্ত করতে আরাকান আর্মি সড়কটির বিভিন্ন অংশ ভেঙে দিয়েছে।

সীমান্তের একাধিক সূত্র জানায়, এই সড়কের বলিবাজার, নাকপুরা, কুমিরখালী, পেরাংপ্রুতে দেশটির সেনাবাহিনী ও বিজিপির সদর দপ্তর এবং বিজিপির পৃথক তিনটি সেক্টর রয়েছে। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে আরাকান আর্মি তুমব্রু রাইট ও লেফটে তিনটি বিজিপি চৌকি দখলে নেয়। ঢেঁকিবনিয়া বিজিপি সেক্টরেও হামলা চালায়। মংডুর দক্ষিণে রাচিডং ও বুচিডং এলাকার কয়েকটি চৌকি দখলের খবর রয়েছে।
এখন দখল করা সীমান্তচৌকি পুনরুদ্ধার এবং আরাকান আর্মিকে পরাজিত করতে রাত-দিন আকাশ থেকে শক্তিশালী বোমা ও মর্টার শেল নিক্ষেপ করছে সরকারি বাহিনী। তাতে হতাহতের সংখ্যাও বাড়ছে। মংডুর দক্ষিণে রাচিডং-বুচিডং শহর হয়ে রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিথুয়ের সরাসরি যোগাযোগ বন্ধ থাকায় মংডু টাউনশিপে খাদ্য ও জ্বালানি তেলের সংকট দেখা দিয়েছে। নানা কৌশলে বাংলাদেশ থেকে খাদ্যপণ্যের সঙ্গে অকটেনসহ বিপুল জ্বালানি তেল সংগ্রহে মরিয়া হয়ে উঠেছে সরকারি বাহিনী।
সীমান্তের লোকজন জানান, গতকাল রাতেও মংডুর উত্তরে বলিবাজার, নাইচাডং, কোয়াচিদং, পেরাংপ্রু গ্রামে গোলাগুলি ও মর্টার শেলের বিস্ফোরণ ঘটেছে। প্রতিদিন ১০০টি করে ধরলে এক মাসে বিস্ফোরণ ঘটেছে তিন হাজারের বেশি। তা ছাড়া অবিস্ফোরিত মর্টার শেল ভবিষ্যতে মৃত্যুফাঁদ হয়ে দেখা দিতে পারে।

টেকনাফ পৌরসভার প্যানেল মেয়র মুজিবুর রহমান বলেন, ওপারের বিস্ফোরণের বিকট শব্দে এপারের  টেকনাফ পৌর শহর, দমদমিয়া, জাদিমুরা, হ্নীলা, উনচিপ্রাং, হোয়াইক্যং এলাকায় ভূকম্পন দেখা দেয়। আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটান অনেকে। ওপারের সংঘাতের দ্রুত নিরসন সম্ভব না হলে আসন্ন রোজার মাসে টেকনাফবাসীর দুঃখ-দুর্দশা আরও বেড়ে যাবে।

পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ওপারের গোলাগুলি–আতঙ্কে তাঁর ইউনিয়নের অন্তত আট হাজার মানুষ নাফ নদীর তীরের লবণ মাঠ, চিংড়ি ও কাঁকড়া চাষের জমিতে যেতে পারছেন না। গ্রামগুলো মিয়ানমার সীমান্তের কাছাকাছি হওয়ায় যেকোনো মুহূর্তে ওপারের গুলি ঘরবাড়িতে আঘাত হানতে পারে।
গত ৫ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের ছোড়া মর্টার শেলের আঘাতে নাইক্ষ্যংছড়ির জলপাইতলীতে একজন নারীসহ দুজন নিহত হন। গোলাগুলিতে আহত হন আরও ৯ জন।

তবে আজ মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত উখিয়া ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত স্বাভাবিক রয়েছে। সেখানকার লোকজন ছয় দিন ধরে ওপারের গোলাগুলি ও মর্টার শেলের বিস্ফোরণ শুনতে পাচ্ছেন না।

রাখাইন পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে উল্লেখ করে টেকনাফ ২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে কঠোর নজরদারি করছে বিজিবি।