মৃত্যুর ৬ বছর পর প্রতিবন্ধী মেয়ের পরিচয়পত্র হাতে পেলেন বাবা

এইচ এম শহীদুল ইসলামের সঙ্গে মেয়ে সুমাইয়া। ২০০৯ সালে তোলা
ছবি: সংগৃহীত

‘ফুরি (মেয়ে) মারা গেছইন ছয় বছর আগে। অখন হিগুর (তাঁর) প্রতিবন্ধী পরিচয়পত্র দিয়া কিতা করতাম? ফুরি বাইচ্চা থাকতে ক্যানে এইটা দিলায় না? কার কাছে উত্তর চাইতাম?’ আজ মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে সিলেট নগরের রিকাবীবাজার এলাকার শহর সমাজসেবা কার্যালয়ে কথাগুলো বলছিলেন নগরের দাড়িয়াপাড়া এলাকার বাসিন্দা এইচ এম শহীদুল ইসলাম।

এ সময় শহীদুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁর দুই মেয়ে ছিল। বড় মেয়ে সুমাইয়া আক্তারের জন্ম ২০০৭ সালে। ২০১০ সালে মেয়ে অসুস্থ হয়। এরপর জানতে পারেন মেয়ে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু। ২০১৩ সালে তিনি মেয়ের প্রতিবন্ধী পরিচয়পত্র তৈরির জন্য শহর সমাজসেবা কার্যালয়ে গিয়ে ছবি তোলেন। এরপর তিনি একাধিকবার সমাজসেবা কার্যালয়ে গিয়েও প্রতিবন্ধী পরিচয়পত্র পাননি।

শহীদুল ইসলাম বলেন, তাঁর মেয়ে ২০১৭ সালে মারা যায়। এরপর থেকে তিনি আর প্রতিবন্ধী পরিচয়পত্রের ব্যাপারে খোঁজ নেননি। তবে গত সোমবার বিকেলের দিকে তাঁর মুঠোফোনে একটি ফোন আসে। অপর প্রান্ত থেকে তাঁকে জানানো হয়, সিলেট শহর সমাজসেবা কার্যালয় থেকে ফোন দেওয়া হয়েছে। তাঁর মেয়ের প্রতিবন্ধী পরিচয়পত্রটি তৈরি রয়েছে। সেটি যাতে তিনি গিয়ে সংগ্রহ করেন।

এ কথা শুনে শহীদুল ইসলাম অনেক কষ্টে নিজেকে সংবরণ করেন। জানতে চান, প্রতিবন্ধী পরিচয়পত্র তৈরি করতে ১০ বছর সময় লাগে কি না? তবে অপর প্রান্ত থেকে তিনি কোনো সদুত্তর পাননি। এ জন্য তিনি আজ আবার সিলেট শহর সমাজসেবা কার্যালয়ে এসে, নিজের প্রশ্নের উত্তর জানতে চেয়েছেন। কারও কাছে তিনি কোনো সদুত্তর পাননি। উল্টো আরও কয়েকজন ভুক্তভোগীকে তিনি পেয়েছেন। তাঁরাও তাঁর মতো ভোগান্তি পোহাচ্ছেন।

মঙ্গলবার দুপুর ১২টা থেকে বেলা দেড়টা পর্যন্ত সিলেটের শহর সমাজসেবা কার্যালয়ে ভুক্তভোগী আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তাঁদের মধ্যে একজন নগরের বোরহানবাগ এলাকার বাসিন্দা ওয়াহেদ আলী। তাঁর মেয়ে মিনা আক্তার মারা গেছে গত বছর। তাঁকেও গতকাল সোমবার মুঠোফোনে কল দিয়ে মেয়ের প্রতিবন্ধী পরিচয়পত্র নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে।

ওয়াহেদ আলী বলেন, চার মেয়ের মধ্যে সবার ছোট ছিল মিনা আক্তার। ২০১৩ সালে তার জন্ম। জন্মের কিছুদিন পরই সে প্রতিবন্ধী, সেটি বুঝতে পারেন। ২০১৪ সালের দিকে প্রতিবন্ধী পরিচয়পত্রের জন্য আবেদন করেছিলেন। কিন্তু সেটির জন্য প্রায় ৯ বছর পর ফোন পেয়েছেন। পরিচয়পত্র না থাকায় তিনি সরকারিভাবে মেয়ের জন্য কোনো সহায়তা পাননি। এর মধ্যে মেয়ে মারা গেছে। এরপরও মেয়ের স্মৃতি হিসেবে তিনি পরিচয়পত্রটি সংগ্রহে রাখতে চান।

আরও পড়ুন

ওয়াহেদ আলী সিলেট শহর সমাজসেবা কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ এনে বলেন, তাঁদের অবহেলার জন্য মেয়ে সরকারি সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। আগে একাধিকবার মেয়ের পরিচয়পত্র সংগ্রহের জন্য খোঁজ করেছেন। তখন তাঁকে পরে যোগাযোগের কথা বলা হয়েছিল। আজ এসে জানতে পেরেছেন মেয়ের পরিচয়পত্র ২০১৬ সালেই প্রস্তুত করা হয়েছে। তাহলে এটা পেতে এত দেরি হলো কেন?

সমাজসেবা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রতিবন্ধীদের পরিচয়পত্র সমাজসেবা কার্যালয়ে নিবন্ধন করে ছবি তোলা হয়। এরপর সেটি বিতরণ করা হয়। প্রতিবন্ধী পরিচয়পত্র না থাকলে সরকারি কোনো সহায়তার আবেদন করার সুযোগ থাকবে না।

প্রতিবন্ধী পরিচয়পত্র নিতে আসা ওই চারজনের পরিচয়পত্রে ইস্যুর তারিখ ২০১৬ সালের বিভিন্ন মাসের তারিখ উল্লেখ করা রয়েছে। কার্যালয়ে একটি টেবিলেও শতাধিক পরিচয়পত্র বিতরণের জন্য রাখা ছিল। এর মধ্যে অধিকাংশ পরিচয়পত্র ২০১৬ সালে ইস্যুর তারিখ উল্লেখ রয়েছে। এ ছাড়া কিছু পরিচয়পত্র ২০১৯ সালে ইস্যুর তারিখ উল্লেখ ছিল।

‌সিলেট শহর সমাজসেবা কার্যালয়। মঙ্গলবার দুপুরে
ছবি: প্রথম আলো

পরিচয়পত্র বিতরণের জন্য সেবা নিতে আসা মানুষজনের সঙ্গে কথা বলছিলেন কার্যালয়ের অফিস সহকারী দ্বীন ইসলাম। তাঁর কাছে দীর্ঘদিন পরিচয়পত্রগুলো হস্তান্তর না করার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, পরিচয়পত্রগুলোর মধ্যে কিছু ঢাকা থেকে এবং কিছু সিলেট জেলা সমাজসেবা কার্যালয় থেকে প্রস্তুত করা হয়েছে। শহর সমাজসেবা কার্যালয়ে পৌঁছাতে দেরি হয়েছে।

বেলা দেড়টার দিকে কার্যালয়ে উপস্থিত হন সিলেট শহর সমাজসেবা কার্যালয়ের অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা মুনতাকা চৌধুরী। তিনি বলেন, তিনি সিলেটের সরকারি শিশু পরিবার বালিকার উপতত্ত্বাবধায়কের দায়িত্বে রয়েছেন। শহর সমাজসেবা কার্যালয়ের কর্মকর্তা চিকিৎসার জন্য ভারতে গেছেন। প্রতিবন্ধী পরিচয়পত্রগুলো বিলি করতে বিলম্ব হওয়ার কারণ তাঁর জানা নেই।

শহর সমাজসেবা কার্যালয়ে ২০১৬ সালের মার্চ মাস থেকে ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেছেন মোহাম্মদ রফিকুল হক। তিনি পদোন্নতি পেয়ে বর্তমানে সিলেট জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন।

তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, দেশের ৪৯২টি উপজেলা ও ৮০টি শহর সমাজসেবা কার্যালয় থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে একটি সার্ভারে প্রতিবন্ধীদের পরিচয়পত্র নিবন্ধন করা হয়। এতে কিছুটা বিলম্ব হতে পারে। নিবন্ধন হওয়ার পর নিজ কার্যালয় থেকেই সেগুলো প্রিন্ট দেওয়া হয়। পরে সেগুলো বিতরণ করা হয়।

২০১৬ সালে নিবন্ধন হওয়া পরিচয়পত্র বিতরণের জন্য সোমবার ফোন দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে রফিকুল হক বলেন, এত বিলম্ব হওয়ার কথা নয়। এমনটি হয়ে থাকলে সেটি দুঃখজনক।

আরও পড়ুন

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, এমন কর্মকাণ্ড দায়িত্ব অবহেলা বলা যায় না। এটি অনৈতিক কাজ। যাঁরা এমন কর্মকাণ্ড করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা কিংবা শাস্তি দেওয়া প্রয়োজন। যাতে ভবিষ্যতে অন্য কেউ এমন কর্মকাণ্ড করতে সাহস না পান।