হলের ডাইনিংয়ে প্রতি কেজি মুরগির মাংস ২৫ টুকরা করা হয়

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭টি আবাসিক হলের খাবার প্রদর্শন করে পুষ্টিমান যাচাই করার দাবিতে শিক্ষার্থীদের অবস্থান। গত রোববার বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে
ছবি: সংগৃহীত

করোনার আগে প্রতি কেজি মুরগির মাংস ১৫ থেকে ১৮ টুকরা করা হতো। বর্তমানে ২৫ টুকরা করা হয়। করোনার আগে একটি ডিম একজনের জন্য বরাদ্দ থাকলেও এখন সেটি ভেজে দুজনকে খাওয়ানো হয়।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলের ডাইনিংয়ে বর্তমান ও তিন-চার বছর আগের খাবারের মধ্যে পার্থক্য জানতে চাইলে কথায় কথায় এসব বলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মাদার বখ্‌শ হলের ডাইনিং কর্মচারী সাবুর আলী। ১৯৯৪ সালের ৭ মার্চ থেকে তিনি চাকরি করছেন।

আরও পড়ুন

শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭টি আবাসিক হলের ডাইনিংয়ে দুপুর ও রাতের খাবার সরবরাহ করা হয়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও খাবারের মান বাড়াতে গত বছরের ১ জুলাই থেকে দুই বেলার খাবারে মোট ৮ টাকা বাড়িয়েছে প্রশাসন। করোনার আগে দুপুরের খাবারের কুপনের দাম ছিল ২৪ টাকা। করোনার পরে সেটি হয়েছে ২৮ টাকা। একইভাবে রাতের খাবার ১৮ টাকার পরিবর্তে ২২ টাকা করা হয়। এ ছাড়া আগে ২ টাকায় বিভিন্ন ভর্তা পাওয়া গেলেও এখন সেগুলো খেতে শিক্ষার্থীদের বাড়তি আরও ৩ টাকা গুনতে হয়। ক্যানটিনের খাবারেরও দাম বেড়েছে। টাকা অনুযায়ী খাবারের মান বাড়েনি অভিযোগ শিক্ষার্থীদের।

কেন্দ্রীয় ক্যাফেটেরিয়ায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, করোনার পর ক্যাফেটেরিয়ায় সাধারণ খাবারের দাম ২৪ টাকার পরিবর্তে ২৮, ব্রয়লার মুরগি ৪৫ টাকার পরিবর্তে ৫০, সোনালি ৭০ টাকার পরিবর্তে ৮০ টাকায় বিক্রি হতো। চলতি শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষার সময় সাধারণ খাবার ছাড়া সব ধরনের খাবারের দাম বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে ব্রয়লার ৫৫ ও সোনালি ৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বিরিয়ানির দামও বাড়ানো হয়েছে। এর আগে গত বছরের নভেম্বরে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কথা বলে প্রতিটি খাবারের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। পরে শিক্ষার্থীদের ক্ষোভের মুখে সেই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা হয়।

আরও পড়ুন

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, দাম বাড়লেও খাবারের মানে কোনো পরিবর্তন হয়নি। মোটা চালের ভাতের সঙ্গে মাছ বা মুরগি ছোট টুকরা দেওয়া হয়। মাংসের টুকরা এর চেয়ে ছোট করা সম্ভব নয়। এসব খাবার খেয়ে পুষ্টির চাহিদা পূরণ তো দূরের কথা, ঠিকঠাক ক্ষুধা নিবারণ হয় না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির দোহাই দিয়ে খাবারের মান বৃদ্ধিতে নজর দিচ্ছে না প্রশাসন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী রাশেদ রানা চার বছর ধরে হলের ডাইনিংয়ে খাওয়াদাওয়া করেন। তিনি বলেন, চার বছরে খাবারের মানের কোনো পরিবর্তন হয়নি। উল্টো দাম বেড়েছে। প্রশাসন খাবারে কোনো ভর্তুকি দেয় না। প্রশাসন চাইলেই খাবারে ভর্তুকি দিয়ে মান বাড়াতে পারে।

রাশেদের মতো একই কথা বলছেন হলের ডাইনিং কর্মচারীরা। তাঁরা বলেন, শিক্ষার্থীদের জন্য ডাইনিংয়ের খাবারে প্রশাসনের কোনো বরাদ্দ নেই। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে তাঁরা চাইলেই খাবারের মান বাড়াতে পারছেন না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাঁদের বেতনের ৮৫ শতাংশ দেয়। বাকি ১৫ শতাংশ বহন করে হল প্রশাসন। বর্তমান বাজারের তুলনায় তাঁদের বেতনও অতি নগণ্য বলে তাঁরা জানান।

বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ক্যাফেটেরিয়ার প্রশাসক এ কে এম আরিফুল ইসলাম বলেন, বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। ভর্তি পরীক্ষার সময় সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা সেটি আরও বাড়িয়ে দেয়। ভর্তি পরীক্ষার সময় বাইরের অনেকে ক্যাফেটেরিয়ায় খাওয়াদাওয়া করেন। তাঁদের জন্য কেন তিনি লোকসান দিয়ে খাওয়াবেন? তাই তিনি দাম বাড়িয়েছেন।

মাছ-মাংস খাওয়া কমিয়েছেন শিক্ষার্থীরা

নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে বিপাকে পড়েছেন বিভিন্ন মেসে থাকা শিক্ষার্থীরা। ঈদুল ফিতরের পর বাজারে চাল, ডাল, মাংসসহ নিত্যপণ্যের দাম হু হু করে বেড়েছে। থেমে নেই সবজির দামও। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়ায় আগের তুলনায় মাছ, মাংস খেতে পারছেন না শিক্ষার্থীরা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষার্থী কাওসার আহমেদ মেহেরচণ্ডী এলাকার একটি মেসে থাকেন। আজ সকালে তিনি ৩০ জনের বাজার করতে স্টেশন বাজারে আসেন। তিনি বলেন, ‘করোনার আগে জনপ্রতি মিল রেট ছিল ৬০ টাকা। সকালে খিচুড়ি, দুপুরে মাছ ও ডাল এবং রাতে মুরগির মাংসের সঙ্গে শাক দেওয়া হতো। বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় মিল রেটও বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু এখন এক বেলায় মাছ ও মাংসের পরিবর্তে ডিম দিতে হচ্ছে।’

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল ও ক্যাফেটেরিয়ায় খাবারের মান বৃদ্ধিসহ পাঁচ দফা দাবিতে মানববন্ধন। মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে
ছবি: প্রথম আলো

বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী রনি আহমেদ বলেন, ‘আমার বাবা কৃষিকাজ করেন। অন্যান্য পেশার মানুষের আয় বাড়লেও আমার বাবার আয় নির্দিষ্ট। বাড়ি থেকে যে টাকা পাঠানো হয়, সেই টাকা দিয়ে চলতে কষ্ট হয়। হোটেলে এক বেলা মুরগির মাংস দিয়ে খেলেই ৬০ থেকে ৭০ টাকা লাগে। ডাইনিংয়ে যে মাছ-মাংস দেওয়া হয়, সেটি নামমাত্র। ডাইনিংয়ে যাঁরা খাওয়াদাওয়া করেন, তাঁদের পুষ্টিহীনতায় ভুগতে হয়।’

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ক্যাফেটেরিয়ায় খাবারের বর্ধিত মূল্য কমানো, আবাসিক হলের ডাইনিংয়ের খাবারের মান বৃদ্ধিসহ পাঁচ দফা দাবিতে আন্দোলন করছে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট ও বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রী। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে মানববন্ধন করে সংগঠন দুটি। এর আগে গত রোববার একই দাবিতে ১৭টি হলের খাবার প্রদর্শন করে খাবারের পুষ্টিমান যাচাই করতে উপাচার্যকে আহ্বান জানিয়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করা হয়। এ ছাড়া গত সোমবার একটি গণস্বাক্ষর কর্মসূচিও পালন করা হয়। এতে তাঁদের দাবির সঙ্গে সংহতি জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের চার শতাধিক শিক্ষার্থী স্বাক্ষর করেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ–উপাচার্য অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইউজিসি থেকে যে বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয়; সেটাতে ডাইনিং ও ক্যাফেটেরিয়ার খাবারে কোনো ভর্তুকি দেওয়ার নিয়ম নেই। তবে আমরা ভর্তুকি যে দিই না, বিষয়টি এমন না। বাবুর্চি ও ডাইনিং কর্মচারীদের বেতন দিতে হয়। শিক্ষার্থীরা আন্দোলন না করে আমাদের সঙ্গে আলোচনা করলে বিষয়টি সমাধান হতে পারত। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে এই টাকা দিয়ে সর্বোচ্চ কী পরিমাণ খাবার দেওয়া যেতে পারে, সেটি নিশ্চিত করতে প্রশাসনের নজরদারি চলছে।’