নিকলী হাওর থেকে ইংলিশ চ্যানেল জয়, সাঁতারু নাজমুলের সাহসী গল্প
৩৭ বছর পর ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশকে নতুন করে গৌরবের আসনে বসিয়েছেন কিশোরগঞ্জের হাওর উপজেলা নিকলীর ছেলে নাজমুল হক (হিমেল)। কিংবদন্তি সাঁতারু ব্রজেন দাস, আবদুল মালেক ও মোশাররফ হোসেনের পথ ধরে নাজমুল হক দেখালেন সাহস, নিষ্ঠা আর অদম্য ইচ্ছাশক্তির অনন্য নজির। তাঁর এই মাইলফলক স্পর্শে গর্বিত পরিবার ও এলাকাবাসী।
সারা বিশ্বে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেওয়া সাঁতারুদের জন্য আলাদা এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। এই চ্যানেল পাড়ি দেওয়ার স্লট পাওয়া দুষ্কর। ঠান্ডা পানি, জেলিফিশ ও প্রাকৃতিক বৈরিতার পাশাপাশি চ্যানেল অতিক্রমের ব্যয়ও অনেক। সব বাধা পেরিয়ে ৩৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে নাজমুলের সময় লেগেছে ১২ ঘণ্টা ১০ মিনিট। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে থাকা এই চ্যানেল জয়ে উচ্ছ্বসিত নাজমুলের পরিবার।
কিশোরগঞ্জের নিকলীর মীরহাটি গ্রামে জন্ম নাজমুলের। চার ভাইবোনের মধ্যে নাজমুল তৃতীয়। বাবা আবুল হাসেম ছিলেন আশির দশকের জাতীয় সাঁতারু। জাতীয় সুইমিং ফেডারেশনের সাবেক সদস্য এবং কিশোরগঞ্জের নিকলী সুইমিং ক্লাবের কোচ। বাবার হাত ধরে নাজমুলের সাঁতারে হাতেখড়ি।
আবুল হাসেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছেলের আত্মবিশ্বাস ছিল। সে করে দেখিয়েছে। এ জন্য ছেলেকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। ইংলিশ চ্যানেলের তাপমাত্রা ১৫ থেকে ১৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। হাওরের তাপমাত্রা বেশি হওয়ায় নাজমুল ড্রামের মধ্যে বরফ রেখে সর্বনিম্ন ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা থেকে নিজেকে প্রস্তুত করেছে। নাজমুলের এমন অর্জনে পুরো পরিবার আবেগাপ্লুত।’
গত রোববার নিকলীতে নাজমুল হকের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা হয়। নাজমুল বলেন, ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেওয়ার স্বপ্ন ছিল। সেটি জয়ের অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। আটলান্টিক মহাসাগরে সাঁতার কাটতে নামার আগে অনেক গবেষণা করেছেন। সবচেয়ে বড় বাধা ছিল ঠান্ডা পানি, জেলিফিশ ও সি সিকনেস। জেলিফিশ দেখে কিছুটা ভয় লেগেছিল। কারণ, সংস্পর্শে লাগলে চামড়ার সঙ্গে লেগে যেত। এটি খুবই রোমাঞ্চকর এক অভিজ্ঞতা ছিল।
নাজমুল হকের সঙ্গে বাংলাদেশের আরেক সাঁতারু মাহফিজুর রহমান (সাগর) ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়েছেন। নাজমুল হক বলেন, ‘আমাদের লাস্ট ফিনিশিং ম্যান ছিল মাহফিজুর রহমান। যখন বোট থেকে হুইসেল দিল, সে ক্লিয়ার। আমাদের মধ্যে তখন যে কী উল্লাস, তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।’
নিজের সাঁতারু হওয়ার বর্ণনা দিয়ে নাজমুল হক বলেন, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সাঁতার শুরু করেন মো. সোলায়মানের কাছে। তারপর জাপানি কোচ ও সবশেষ চীনা কোচের অধীন দক্ষতা বৃদ্ধি করেছেন। ১৯৯৮ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত সাঁতারের বিভিন্ন ইভেন্টে অংশ নিয়ে ২৬টি স্বর্ণ ও ২১টি রৌপ্যপদক পেয়েছেন। বয়সভিত্তিক সাঁতারেও গড়েছেন ছয়টি জাতীয় রেকর্ড। এ পরিসংখ্যান শুধু সংখ্যা নয়, একেকটি অধ্যায়, একেকটি লড়াইয়ের গল্প।
নাজমুল হক বলেন, ‘আমার বাবা আশির দশকের একজন সাঁতারু। আমার আরও দুই ভাই আছে, তারাও সাঁতারু। তাদের সন্তানেরাও সাঁতারু। পারিবারিকভাবে আমরা যেহেতু সবাই সাঁতারু, আমাদের ইচ্ছা থাকে বড় কিছু করার। আমাদের কেউই অলিম্পিকে যাইনি। এটা আমার মনে আক্ষেপ ছিল। তাই পরিকল্পনা ছিল, বড় একটা ইভেন্টে অংশ নেব।’
স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, নাজমুল হক তাঁদের এলাকার গর্ব। তাঁকে দেখে নতুন প্রজন্ম সাঁতারু হতে আগ্রহী হয়ে উঠবে। তাঁদের আক্ষেপ, নিকলী থেকে দেশের জন্য এত এত সাঁতারু গৌরব বয়ে আনলেও এখানে কোনো সুইমিংপুল নেই। প্রশাসন ও কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে নজর দেওয়ার অনুরোধ তাঁদের।
নিকলী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রেহানা মজুমদার বলেন, নিকলীতে কোনো সুইমিংপুল নেই। উপজেলা পরিষদের পুকুরেই ছেলেরা সাঁতার শিখছে। নাজমুলের বিজয় বিশ্বের বুকে লাল-সবুজের পতাকার সম্মান ও হাওর এলাকার সুনাম বাড়িয়েছে। আত্মবিশ্বাস ও কঠোর পরিশ্রমে তিনি বিশ্ব জয় করেছেন। তাঁর পথ ধরে হাওরে আরও খ্যাতিমান সাঁতারু তৈরি হবে। জেলা ক্রীড়া সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করে খুব দ্রুতই তাঁরা সাঁতারুদের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করবেন।
গত ২৯ জুলাই বাংলাদেশ সময় সকাল সাড়ে আটটায় ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিতে নামেন নাজমুলরা। বিখ্যাত এই চ্যানেল অতিক্রম করা প্রথম এশীয় বাঙালি ব্রজেন দাস। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬১ সালের মধ্যে মোট ছয়বার চ্যানেলটি অতিক্রম করেন তিনি। ১৯৬৫ সালে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেন আবদুল মালেক। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের প্রথম সাঁতারু হিসেবে ১৯৮৮ সালে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেন মোশাররফ হোসেন। এরপর দীর্ঘ ৩৭ বছর পর আবার ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিলেন বাংলাদেশের দুই সাঁতারু নাজমুল হক ও মাহফিজুর রহমান।