বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যা ও আত্মহত্যার চেষ্টার ঘটনা বেড়েছে। চলতি বছরের সাড়ে পাঁচ মাসে তিন শিক্ষার্থী আত্মহনন করেছেন। গত বছরের জুলাইয়ে মেসের কক্ষে ‘আত্মহত্যা’ করেন উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী। এ ছাড়া গত দেড় বছরে অন্তত ১০ শিক্ষার্থী আত্মহত্যার চেষ্টা চালান। এ নিয়ে অভিভাবক ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে উদ্বেগ বাড়ছে।
সর্বশেষ রোববার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের পাঠকক্ষ থেকে এক ছাত্রীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। রোববার রাত ১১টার দিকে শেফা নূর ইবাদি নামের ওই ছাত্রীকে পাঠকক্ষের জানালার গ্রিলের সঙ্গে ফাঁস দেওয়া অবস্থায় পাওয়া যায়। ধারণা করা হচ্ছে, তিনি আত্মহত্যা করেছেন।
শেফা নূর ইবাদি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের স্নাতক চতুর্থ বর্ষে পড়তেন। তাঁর বাড়ি পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলায়। তিনি বঙ্গমাতা হলে থাকতেন।
শিক্ষার্থীদের ভাষ্য, দেড় বছরে যতগুলো আত্মহননের ঘটনা ঘটেছে কিংবা আত্মহননের চেষ্টা হয়েছে, তার সব ঘটনার পেছনেই প্রেমঘটিত বিষয় ছিল।
শিক্ষক ও সহপাঠীরা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রের সঙ্গে ওই ছাত্রীর প্রেম ছিল। দুজনের মনোমালিন্য হওয়ায় ওই ছাত্রকে ভিডিও কলে রেখে আত্মহত্যা করেন তিনি। একই দিন বেলা ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে কোটা বাতিলের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন শেফা।
শিক্ষার্থীদের ভাষ্য, দেড় বছরে যতগুলো আত্মহননের ঘটনা ঘটেছে কিংবা আত্মহননের চেষ্টা হয়েছে, তার সব ঘটনার পেছনেই প্রেমঘটিত বিষয় ছিল।
গত ১৭ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে অবস্থিত একটি মেসে ‘আত্মহত্যা’ করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী বৃষ্টি সরকার। গত বছরের জুলাইয়ে একই কায়দায় মেসের কক্ষে ‘আত্মহত্যা’ করেন উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী শাহরিন রিভানা। চলতি বছরের ১৭ মার্চ বরগুনায় স্বামীর কর্মস্থলে ‘আত্মহত্যা’ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর শ্রেণির আরেক শিক্ষার্থী দেবশ্রী রায়।
এ ছাড়া গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত অন্তত ১০ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যার চেষ্টা চালান। তবে সহপাঠীদের চেষ্টায় তা ব্যর্থ হয়। তাঁদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু হলে দুজন ছাত্র, শেরেবাংলা হলে তিনজন ছাত্র, শেখ হাসিনা হলে একজন ছাত্রী, রূপাতলী হাউজিং এলাকায় নিজ নিজ মেসে দুজন ছাত্র ও এক ছাত্রী, শেখ হাসিনা হলের সামনে এক ছাত্র এবং ঝালকাঠিতে নিজ বাসভবনে একজন ছাত্র আত্মহত্যার চেষ্টা করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগ ‘কাজে আসছে না’
শিক্ষার্থীরা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নানা কারণে মানসিক জটিলতা, সম্পর্কের টানাপোড়েন, উদ্বিগ্নতা-নিঃসঙ্গতায় থাকেন। এ জন্য গত মার্চে বিশ্ববিদ্যালয়ে মেন্টাল হেলথ কাউন্সেলিং অ্যান্ড গাইডেনস সেন্টার চালু করা হয়েছে। এর আওতায় ঢাকা থেকে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এখানে এসে সেমিনার ও কাউন্সেলিং সেবা দেন। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অনলাইনে সেমিনার ও পরামর্শ দেন। কিন্তু এসব সেমিনারে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি থাকে খুবই কম।
দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো, আমাদের শিক্ষার্থীরা এসব সেমিনারে এবং চিকিৎসা নিতে খুব একটা আসেন না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের স্নাতকোত্তরের ছাত্র ও বঙ্গবন্ধু হলের আবাসিক শিক্ষার্থী জয়নাল আবেদীন বলেন, আত্মহত্যার প্রবণতা কাজ করে এমন শিক্ষার্থীদের কাউন্সেলিং, মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন করার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে উদ্যোগ থাকলেও তা খুব একটা কাজে আসছে না। অনেক সময় এ ধরনের সমস্যা নিয়ে শিক্ষার্থীরা লোকলজ্জায় চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে বা কাউন্সেলিং করাতে চান না। ফলে সমস্যাটি প্রকট হচ্ছে।
শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও বেশ উদ্বিগ্ন। তবে এই উদ্বেগ নিরসনে উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়টি এগোচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর মো. আবদুল কাইয়ুম গতকাল সোমবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের শিক্ষার্থীরা যেভাবে ঘন ঘন নিজেদের জীবননাশের মতো সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তা শিক্ষক হিসেবে আমাদের রীতিমতো পীড়া দিচ্ছে এবং উদ্বেগে ফেলছে। শেফা নূর ইবাদি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ও উদ্যোগী ছিলেন। তিনি এভাবে আত্মহননের পথ বেছে নেবেন, এটা আমাদের কল্পনাতেও ছিল না।’
আত্মহননের প্রবণতা রোধে বিশ্ববিদ্যালয়ের নেওয়া উদ্যোগগুলোর কথা জানিয়ে প্রক্টর বলেন, ‘দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো, আমাদের শিক্ষার্থীরা এসব সেমিনারে এবং চিকিৎসা নিতে খুব একটা আসেন না। আত্মহত্যার প্রবণতা রোধে আমরা আরও সিদ্ধান্ত নিয়েছি, প্রতিটি হলে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হবে ও ছুটির সময় হলে কোনো শিক্ষার্থী থাকতে পারবেন না। একই সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর সেমিনারগুলোতে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বাড়াতে আমরা আরও কঠোর হব।’
মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে আত্মহত্যার ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, সাধারণত দুই ধরনের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে আবেগতাড়িত (ইমপালসিভ) আত্মহত্যা একটি। এটা মূলত রেগে গিয়ে বা হঠাৎ আবেগপ্রবণ হয়ে ঝোঁকের বশে মৃত্যু চেষ্টা। যেমন ঝগড়া করতে করতে হঠাৎ ছাদ থেকে লাফ দিয়ে পড়া বা কোনো মানসিক রোগে কারণ ছাড়াই আত্মহত্যার চেষ্টা করা। অপরটি হচ্ছে সংকল্পিত ও পরিকল্পিত (ডিসাইসিভ অ্যান্ড প্ল্যানড) আত্মহত্যা। এ ধরনের আত্মহত্যার ক্ষেত্রে যিনি আত্মহত্যা করতে চান, দীর্ঘ সময় ধরে তিনি আত্মহত্যার পরিকল্পনা করেন, উপকরণ সংগ্রহ করেন এবং আটঘাট বেঁধে, সুইসাইডাল নোট লিখে রেখে আত্মহত্যা করতে চান।
আত্মহত্যার প্রবণতা থেকে শিক্ষার্থীদের বের করে আনতে হলে শিক্ষার্থীদের সামাজিক দক্ষতা বাড়াতে হবে ও তাঁদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ করে দিতে হবে।
আত্মহননের অবস্থা থেকে উত্তরণের বিষয়ে জানতে চাইলে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ মো. আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এই প্রবণতা থেকে শিক্ষার্থীদের বের করে আনতে হলে শিক্ষার্থীদের সামাজিক দক্ষতা বাড়াতে হবে ও তাঁদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ করে দিতে হবে। একইভাবে পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাঁদের দায়িত্ব দিতে হবে। স্কুল-কলেজে, ক্লাবে সক্রিয় হতে হবে এবং সংস্কৃতিচর্চা করতে উৎসাহিত করতে হবে।
শিক্ষার্থীদের যেকোনো ধরনের মানসিক সমস্যা বা আত্মহত্যার ইঙ্গিত পেলে দ্রুত মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, বিষণ্নতা, মাদকাসক্তি, ব্যক্তিত্বের বিকার, সিজোফ্রেনিয়াসহ সব ধরনের মানসিক রোগ দ্রুত শনাক্ত করে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা উচিত। একইভাবে মানসিক রোগীকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য না করে তাঁর মর্যাদা সুরক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।