‘একটা ছোডু মাইয়া থুইয়া গেছে দীপু, হেদের কী অইবো—এইডা সরকার দেহুক’
মাত্র ২১ বছর বয়সে বিধবা হয়েছেন মেঘনা রানী রবিদাস। দেড় বছরের মেয়েকে নিয়ে অথই সাগরে পড়েছেন। বাবার আদর-ভালোবাসা বোঝার আগেই শিশুটিকে নিয়ে কোথায় দাঁড়াবেন, এমন দুশ্চিন্তা এখন ভর করেছে পরিবারটিতে।
কোলের শিশুটির কান্না থামানোর চেষ্টা করে মেঘনা বলেন, ‘আমাদের কী হবে এখন। মাত্র ৩ বছরের সংসার আমার, শেষ হয়ে গেল। আমার স্বামীকে (দীপু চন্দ্র দাস) নিয়ে সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখছিলাম।’
ময়মনসিংহের ভালুকায় হত্যাকাণ্ডের শিকার পোশাকশ্রমিক দীপু চন্দ্র দাসের গ্রামের বাড়ি তারাকান্দা উপজেলার মোকামিয়াকান্দা গ্রামে আজ মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে যান এই প্রতিবেদক। তখন বাড়ির পাশেই দীপুর স্মরণে নানা ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা করছিলেন পরিবারের সদস্যরা। ওই সময় কথা হয় মেঘনা রানীর সঙ্গে, কোলে ছিল মেয়ে।
পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সর্বশেষ ১৫ ডিসেম্বর রাত ২টার দিকে বাড়িতে আসে দীপু। স্ত্রী-সন্তান ও পরিবারের সঙ্গে আনন্দময় সময় কাটিয়ে ১৭ ডিসেম্বর ভোরে আবার চলে যান কর্মস্থলে। এটিই যে শেষ যাওয়া, তা ভাবতে পারেনি পরিবার। পরদিন ১৮ ডিসেম্বর রাতেই নৃশংসভাবে হত্যার শিকার হন দীপু।
ঘটনার দিন বিকেল ৫টার দিকেও দীপুর সঙ্গে কথা হয় জানিয়ে মেঘনা রানী বলেন, ‘বাচ্চার খবর নিছিল, আমরা কে কী করছি, সব খবর নেয়। তাঁর সঙ্গে কারখানায় কোনো ঝামেলা আছে, এমন কথা কখনো বলেনি, পদোন্নতির কোনো কথাও শুনিনি। কিন্তু আমার স্বামী যে হত্যার শিকার হলো কোনো অপরাধ ছাড়াই!’
তারাকান্দা বাজারে শ্রমিকের কাজ করেন দীপুর বাবা রবি চন্দ্র দাস। বড় ছেলে দীপুকে হারিয়ে হতবিহ্বল হয়ে পড়েছেন তিনিও। রবি চন্দ্র দাস বলেন, তিন ভাইয়ের মধ্যে দীপু সবার বড় ছিলেন। তাঁর ভাষ্য, ‘আমার ছেলে ডিগ্রি দ্বিতীয় বর্ষ পড়ার পর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর গার্মেন্টসে কাজ করত। সে–ই আমার সংসারের হাল ধরেছিল; কিন্তু আমার ছেলেটারে শেষ কইরা দিছে।’
মানতে পারছে না এলাকাবাসীও
আজ মঙ্গলবার বেলা সোয়া ১১টার দিকে দীপু চন্দ্র দাসের বাড়ির সামনে দেখা যায়, একটি দেয়ালে টানানো হয়েছে বিচারের দাবি–সংবলিত দুটি ব্যানার। পরিবারকে সান্ত্বনা ও ব্যানারের সামনে দাঁড়িয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা। তাঁদের একজন জালাল উদ্দিন (৬২)। তিনি পূর্ব তালদীঘি গ্রামের বাসিন্দা।
জালাল উদ্দিনের ভাষ্য, ‘পরিবারডারে সান্ত্বনা দিতে আইছিলাম। হেরা খালি কান্দাকাডি করে। ছেলেডা এলাকার লাগি এক নম্বরের আছিন। ছেলেডারে হুদাই মারছে। এইরম কাম যেন আর কেউ না করে, একটা ডাডি (শক্ত) বিচার করুইন।’
আক্ষেপ নিয়ে পূর্ব তালদীঘি গ্রামের কদবানু (৫৫) বলেন, ‘এই রহম নিরীহ ছেলে আমাদের এলাকায় নাই। ছেলেডারে মাইরালছে হুইনা আমরা চোক্কের পানি ধইরা রাখতাম পারি নাই। আমরা এইডার বিচার চাই।’
মোকামিয়াকান্দা গ্রামের আবদুর রশিদ বলেন, ‘আমরা ফেসবুকে দেখছি, ছেলেডারে মাইরা গাছে লটকাইয়া পরে আগুন দিছে। এইডা দেইখা আমরার খুব কষ্ট হইছে। আমরা কঠিন বিচার চাই।’
দীপু দাসের চাচি মিনতী রানী পরিবারটির আর্থিক দুরবস্থার কথা তুলে ধরে বলেন, ‘ওর (দীপুর) বাপটা বাজারে কুলির কাম কইরা মাইনসের কাছে চায়া-মাইগ্যা টেহা দিয়া স্কুলে-কলেজে পড়াইয়া ছেরাডারে মানুষ করছে। এদের জীবনডাই কষ্টে গেছে। একটা ছোডু মাইয়া থুইয়া গেছে দীপু। হেদের কী অইবো—এইডা সরকার দেহুক।’
ভালুকার হবিরবাড়ী ইউনিয়নের ডুবালিয়াপাড়া এলাকায় গত বৃহস্পতিবার রাতে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে পাইওনিয়ার নিটওয়্যারস (বিডি) লিমিটেড কারখানার কর্মী দীপু চন্দ্র দাসকে ধরে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। পরে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের বিভাজকের একটি গাছে বিবস্ত্র করে ঝুলিয়ে মরদেহে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
দীপু চন্দ্র তারাকান্দা উপজেলার বানিহালা ইউনিয়নের মোকামিয়াকান্দা গ্রামের রবি চন্দ্র দাসের ছেলে। এ ঘটনায় তাঁর ভাই অপু চন্দ্র দাস বাদী হয়ে গত শুক্রবার অজ্ঞাতপরিচয় ১৪০ থেকে ১৫০ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেন।
দীপুর বাড়িতে অধিকারকর্মীরা
আজ মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে অধিকারকর্মীদের ১৭ সদস্যের একটি দল দীপু চন্দ্রের বাড়িতে গিয়ে পরিবারের খোঁজ নেন এবং ন্যায়বিচারের জন্য সব ধরনের আইনগত সহায়তার আশ্বাস দেন।
নাগরিক সংগঠন কোয়ালিশন, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), মৌলিক অধিকার সুরক্ষা কমিটি, সম্প্রীতি যাত্রা, আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), মানবাধিকার সাংস্কৃতিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ দলিত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠী অধিকার আন্দোলন (বিডিইআরএম), হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি ও অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট (এএলআরডি)–এর প্রতিনিধিরা এতে অংশ নেন।
প্রতিনিধিদলটির সদস্যরা দীপুর পরিবারের পাশে সরকারকে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান। তাঁরা বলেন, দীপু হত্যার পর সরকারের কাছ থেকে এখনো স্পষ্ট বার্তা পাওয়া যায়নি। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে তাঁরা বিচার দাবি করছেন। পরিবারের জন্য উপযুক্ত ক্ষতিপূরণও দিতে হবে। এটাই যেন দেশে এ ধরনের শেষ ঘটনা হয়।
নাগরিক সংগঠন কোয়ালিশনের সদস্য আলোকচিত্রী শহিদুল আলম বলেন, ‘এতগুলো মানুষ রক্ত দেওয়ার পর বৈষম্যহীন বাংলাদেশ পাব, আমরা ভেবেছি। কিন্তু সেখানে এ রকম অপবাদ দিয়ে বিনা প্রমাণে নৃশংসভাবে একটা মানুষকে হত্যা করা হলো, তার লাশকে পোড়ানো হলো, অসম্মান করা হলো; সেটি আমাদের জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক।’
লেখক ও নৃবিজ্ঞানী রেহনুমা আহমেদ বলেন, ‘সারা দেশে পরপর যে ঘটনাগুলো ঘটছে, তাতে আমরা স্তব্ধ। দীপুর হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটিও আমাদের স্তব্ধ করেছে। আমাদের প্রশ্ন করতে হবে, এই ঘটনা কীভাবে ঘটল?’
বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)–এর পরিচালক মাহবুবা আখতার তাঁদের পক্ষ থেকে সব রকম আইনগত সহায়তার আশ্বাস দেন।
এ সময় আরও ছিলেন মৌলিক অধিকার সুরক্ষা কমিটির সদস্য জাকির হোসেন, লেখক ও অ্যাকটিভিস্ট বাকী বিল্লাহ, সম্প্রীতি যাত্রার সংগঠক কবি ফেরদৌস আরা রুমি, মানবাধিকার কর্মী দীপায়ন খীসা, বাংলাদেশ দলিত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠী অধিকার আন্দোলন (বিডিইআরএম) সাধারণ সম্পাদক শিপন কুমার রবিদাস, অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি) প্রতিনিধি রফিকুল ইসলাম ও সোহেল রানা, মানবাধিকার সাংস্কৃতিক ফাউন্ডেশনের সদস্য আসমা উল হুসনা, বাংলাদেশ নারীমুক্তি কেন্দ্রের সভাপতি সীমা দত্ত, আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) প্রতিনিধি তাওহিদ আহমেদ রানা প্রমুখ।