মেয়ের বাড়ি দাওয়াতে যাওয়ার পথে স্ত্রী, পুত্রবধূ ও নাতনিকে হারিয়ে বাক্‌রুদ্ধ সন্তোষ

স্ত্রীর লাশের পাশে বসে আছেন বাক্‌রুদ্ধ সন্তোষ পাত্র। সোমবার দুপুরে সিলেটের এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগেছবি: আনিস মাহমুদ

হাসপাতালের জরুরি বিভাগের এক প্রান্তে চারটি শয্যায় সাদা কাপড়ে ঢেকে রাখা হয়েছে চারটি লাশ। গায়ে রক্তে ভেজা কাপড় নিয়ে এক শয্যা থেকে আরেক শয্যায় ছুটে বেড়াচ্ছেন সন্তোষ পাত্র (৬০)। তাঁর মুখে কোনো কথা নেই। শুধু চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছে। ঘুরতে ঘুরতে একপর্যায়ে স্ত্রীর লাশ থাকা শয্যার পাশে বসে পড়েন তিনি। এ সময় সেখানে আসেন মেজ ছেলে লব পাত্র। তাঁকে দেখে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন সন্তোষ। নীরবতা ভেঙে অনেকটা জোরেই কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘তদের মা, বউদি দুজনই চলে গেল। তদের মায়ের ইচ্ছা আছিল ছেলে-মেয়ে সবার বিয়ে দেইখা যাইত। কিন্তু সে আশা ফুরাইল না।’

সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে সোমবার দুপুরের পর এ দৃশ্য দেখা যায়। জেলার জৈন্তাপুর উপজেলার দরবস্ত এলাকায় সোমবার দুপুরে লেগুনা ও পিকআপের মুখোমুখি সংঘর্ষে ছয়জন নিহত হন। এর মধ্যে সন্তোষের স্ত্রী মঙ্গলী পাত্র (৫০), পুত্রবধূ সুচিত্রা পাত্র (৩৫) ও নাতনি বিজলী পাত্রও (৬ মাস) আছেন। তাঁদের বাড়ি জৈন্তাপুর উপজেলার চিকনাগুল ইউনিয়নের পশ্চিম ঠাকুরের মাটি গ্রামে।

আরও পড়ুন

নিহত বাকি তিনজনও সন্তোষ পাত্রের স্বজন। তাঁরা হলেন একই গ্রামের নন্দ পাত্রের স্ত্রী সাবিত্রী পাত্র (৩৫), সুবেন্দ্র পাত্রের মেয়ে ঋতু পাত্র (৮) ও নিপেন্দ্র পাত্রের স্ত্রী শ্যামলা পাত্র (৫৫)। সন্তোষ পাত্রের ছোট মেয়ের বাড়িতে দাওয়াতে যাওয়ার পথে এ দুর্ঘটনা ঘটে বলে পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে।

মা শ্যামলা পাত্রের লাশ নিয়ে মেয়ে নমিতা পাত্রের আহাজারি। সোমবার দুপুরে সিলেটের এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে
ছবি: প্রথম আলো

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সন্তোষ ও মঙ্গলী দম্পতির চার ছেলে, দুই মেয়ে। এর মধ্যে বড় ছেলে ও দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে। ছোট মেয়ে অনামিকা পাত্রের বিয়ে হয়েছে ২১ দিন আগে। সোমবার মেয়ের বাড়িতে তাঁদের প্রথম দাওয়াত ছিল। তাঁদের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী সংস্কৃতিতে মেয়ের বাড়িতে প্রথম দাওয়াত পেলে আত্মীয়স্বজনদের নিয়ে যেতে হয়। সে অনুষ্ঠানকে তাঁরা ‘জলপান’ বলেন। এ জন্য প্রায় ৫০-৬০ জন আত্মীয়স্বজন মিলে পাঁচটি লেগুনায় করে অনামিকার বাড়িতে যাচ্ছিলেন। মেয়ের বাড়িতে দুপুরের খাবার খেয়ে তাঁদের ফিরে আসার কথা ছিল। দুপুর পৌনে ১২টার দিকে সিলেট-তামাবিল আঞ্চলিক মহাসড়কের জৈন্তাপুরের দরবস্ত পল্লী বিদ্যুৎ কার্যালয়ের সামনে পৌঁছালে একটি লেগুনার সঙ্গে গরুবাহী পিকআপের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়।

আরও পড়ুন

সন্তোষের মেজ ছেলে লব পাত্র বলেন, দুর্ঘটনায় তাঁর ভাবির কোলে থাকা ছয় মাসের শিশুটিও মারা গেছে। বড় ভাই কুশ পাত্র হাসপাতালে অচেতন অবস্থায় চিকিৎসাধীন। এদিকে তাঁদের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসে আরও তিন স্বজনের মৃত্যু হয়েছে। সেটি মেনে নিতে পারছেন না তাঁরা। তিনি বলেন, তাঁর বাবা ও তিনি পেছনের লেগুনায় ছিলেন। যে লেগুনাটি দুর্ঘটনাকবলিত হয়েছে, সেটি তাঁদের সামনে ছিল। তবে তাঁরা ঘটনাটি দেখেননি। ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখতে পেয়েছেন মানুষের জটলা। লাশ ছড়িয়ে–ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে। তাঁর মায়ের একটি হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।

সড়ক দুর্ঘটনায় লেগুনাটি দুমড়েমুচড়ে গেছে। আজ সিলেট-তামা‌বিল আঞ্চ‌লিক সড়কের দরবস্ত পল্লী বিদ্যুৎ কার্যালয়ের সামনে
ছবি: প্রথম আলো

পুলিশ ও নিহত ব্যক্তিদের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, দুর্ঘটনার পর হতাহত ব্যক্তিদের সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর প্রথমে তিনজনকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও দুজনের মৃত্যু হয়। দুর্ঘটনার পর আহত ছয় মাসের শিশু বিজলি পাত্রকে জৈন্তাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়েছিল। সেখানে তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন দায়িত্বরত চিকিৎসক।

দুর্ঘটনার পর স্থানীয় লোকজন বিক্ষুব্ধ হয়ে ঘটনাস্থলে প্রায় দেড় ঘণ্টা সড়ক অবরোধ করেন। খবর পেয়ে জৈন্তাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তাজুল ইসলামসহ পুলিশ সদস্যরা ঘটনাস্থলে যান। স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে নিয়ে ওসি বিক্ষুব্ধ লোকজনের সঙ্গে কথা বলেন। পরে তাঁরা সড়ক থেকে সরে যান।