পছন্দের জীবনসঙ্গী খুঁজতে ২০০ বছর ধরে যেখানে জড়ো হন তরুণ-তরুণীরা

পছন্দের জীবনসঙ্গী খুঁজতে বাসিয়াহাট বউ মেলায় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ছেলেমেয়েরা।বুধবার বিকেলে দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার গোলাপগঞ্জ উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে
ছবি: প্রথম আলো

হাতে চুড়ি, কপালে টিপ, খোঁপায় গোঁজা ফুল। রঙিন শাড়িতে অপরূপ সাজে মেলায় জড়ো হয়েছেন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মেয়েরা। পছন্দের জীবনসঙ্গীর খোঁজে দূর-দূরান্ত থেকে মেলায় হাজির হয়েছেন তরুণ-তরুণীরা। পরস্পরের পছন্দ হলেই বেজে ওঠে সানাইয়ের সুর। প্রথমে আলাপচারিতা, তারপর অভিভাবকদের জানানো এবং শেষে ধুমধাম করে শুরু হয় বিয়ের আয়োজন।

গতকাল বুধবার বিকেলে জীবনসঙ্গী খোঁজার ব্যতিক্রম এ মেলা বসেছিল দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার গোলাপগঞ্জ উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে। স্থানীয় লোকজনের কাছে মেলাটি বাসিয়াহাট বা বউমেলা নামে পরিচিত।

প্রায় ২০০ বছর ধরে এ মেলার আয়োজন করছেন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। সাধারণত দুর্গাপূজার বিজয়া দশমীর পরদিন এ মেলা বসে। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর তরুণ-তরুণীদের পাশাপাশি সনাতন ও ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষও উপস্থিত হন এ মেলায়।

স্থানীয় প্রবীণ বাসিন্দারা জানান, আগে মেলায় তরুণ-তরুণীরা পছন্দের মানুষ খুঁজে পেলে পরিবারের কাছে জানাতেন। পরের বছর মেলায় তাঁদের নাম-পরিচয় তুলে ধরে বিয়ের আয়োজন করা হতো। এখনো অনেকেই মেলায় ছেলেমেয়ের জীবনসঙ্গী খুঁজে পেলে হয়তো বিয়ে দেন। তবে আগের মতো বিয়েশাদির ব্যাপারগুলো এখন আর নেই। এরপরও ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন আয়োজকেরা।

বউমেলা ঘিরে নানা পণ্যের পসরা নিয়ে বসেন বিক্রেতারা। বিদ্যালয়ের মাঠসহ পুরো গোলাপগঞ্জ বাজার এলাকা পরিণত হয় জনসমুদ্রে। জিলাপি, নিমকি, পিঠা, ফুচকা, চটপটিসহ বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রীর দোকানের পাশাপাশি মেয়েদের অলংকারের দোকান, শিশুদের খেলনাসামগ্রী, গৃহস্থালির নানা সরঞ্জাম, তৈজসপত্র, মাটির তৈরি জিনিসসহ দেড় সহস্রাধিক দোকান বসে এ মেলায়।

মেলা উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। দিনাজপুর ছাড়া পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, জয়পুরহাট ও নওগাঁ জেলা থেকেও অনেক মানুষ মেলায় আসেন। মেলা উপলক্ষে বিদ্যালয়ের মাঠে বসে নাচ-গানের আসর। ঢোল, মন্দিরা, কাঁসর, কাড়া, হারমোনিয়ামের তালে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ছেলেমেয়েরা দলীয় ও এককভাবে তাঁদের ঐতিহ্যবাহী নৃত্য পরিবেশন করেন।

নওগাঁ জেলা থেকে মেলায় এসেছেন তরুণ মার্ডি (৩২)। তিনি বলেন, ‘বাপ-দাদার কাছে এই মেলার গল্প যেভাবে শুনেছি, এখন আর সেটা দেখা যায় না। তবে মেলায় তরুণ-তরুণীদের উপস্থিতি দেখে মেলার ইতিহাসের সঙ্গে কিছুটা মিল পাওয়া যায়। খুবই ভালো লাগছে অন্তত ঐতিহ্যটা এখনো ধরে রাখা গেছে বলে।’

মেলা উপলক্ষে বিদ্যালয়ের মাঠে বসে নাচ-গানের আসর। ঢোল, মন্দিরা, কাঁসর, কাড়া, হারমোনিয়ামের তালে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ছেলেমেয়েরা দলীয় ও এককভাবে তাঁদের ঐতিহ্যবাহী নৃত্য পরিবেশন করেন
ছবি: প্রথম আলো

পঞ্চগড় থেকে আসা রীতা হেমব্রম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখানে আমাদের এক আত্মীয় আছেন। আগেও এই মেলায় এসেছি। তবে এবার মেলায় লোকজন অনেক বেশি। সবচেয়ে ভালো লাগে যে মেলায় সব ধর্মের মানুষই উপস্থিত থাকে।’

জানতে চাইলে মেলা আয়োজক কমিটির পক্ষে বীরগঞ্জ আদিবাসী সমাজ উন্নয়ন সমিতির সদস্য শ্যাম লাল মুরমু বলেন, ঠিক কবে থেকে মেলার প্রচলন শুরু হয়েছে, তা বলা যায় না। পূর্বপুরুষেরা করে গেছেন। তাঁরা শুধু ধারাবাহিকতা রক্ষা করে যাচ্ছেন। মেলায় সব ধর্মের মানুষ উপস্থিত হয়।

আরও পড়ুন

মেলায় উপস্থিত ছিলেন দিনাজপুর-১ (বীরগঞ্জ-কাহারোল) আসনের সংসদ সদস্য মনোরঞ্জন শীল গোপাল। তিনি বলেন, নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিতে বর্তমান সরকার কাজ করে যাচ্ছে। কাউকে পেছনে ফেলে নয়, একসঙ্গে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে তারা কাজ করে যাচ্ছে। আজকের আয়োজন তারই সাক্ষ্য বহন করে।

এ সময় অন্যদের মধ্যে পুলিশ সুপার শাহ ইফতেখার আহমেদ, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খোদাদাদ হোসেন, সহকারী কমিশনার (ভূমি) রাজ কুমার বিশ্বাস প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।