‘৯ মাসের মেয়েটার মা, নানি ও দাদি—সবাই গেল’

মা, স্ত্রী আর শাশুড়িকে হারিয়ে সোহেল পাগলপ্রায়। মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার ভদ্রাসন গ্রামে রোববার
ছবি: প্রথম আলো

সোহেল খানের নিজের বাড়ি আর শ্বশুরবাড়ি—দুই জায়গাতেই কান্নার রোল। এক দুর্ঘটনায় মা, স্ত্রী আর শাশুড়িকে হারিয়ে সোহেল পাগলপ্রায়। সোহেলের আপন বলতে এখন আছে ৯ মাসের মেয়ে। সোহেল বলেন, ‘আমার ৯ মাসের সন্তান রেখে আমার মা, স্ত্রী ও শাশুড়ি চলে গেল। আমার ৯ মাসের অবুঝ শিশুর কী হবে? ও মা ডাকার আগেই ওর মাকে আল্লায় নিয়া গেল।’

সোহেল খানকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন তাঁর চাচাতো ভাই মো. দুলাল খান। তাঁর চোখেও জল। তিনি বলেন, ‘সোহেলের মা মারা গেছে। আবার স্ত্রী ও শাশুড়ি মারা গেছে। এত শোক সইতে পারা কষ্টের! একবার মায়ের লাশের কাছে, আরেকবার স্ত্রী-শাশুড়ির লাশের কাছে দৌড়াদৌড়ি করছে সোহেল। ৯ মাসের মেয়েটার মা, নানি ও দাদি—সবাই গেল। বাবা ছাড়া শিশুটিকে বড় করার কেউ রইল না।’

এর আগে গতকাল শনিবার বিয়ের বাড়িতে যাওয়ার পথে বরগুনার আমতলীতে সেতু ভেঙে সাতজন মারা গেছেন। তাঁরা সবাই মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার ভদ্রাসন গ্রামের। রোববার সকালে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁদের দাফন সম্পন্ন হয়। এর আগে রাত তিনটার দিকে লাশ বাড়িতে পৌঁছালে কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বজনেরা।

দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিরা হলেন ভদ্রাসন গ্রামের আবুল কালাম আজাদের স্ত্রী শাহানাজ আক্তার (৪০) এবং তাঁর দুই মেয়ে তাহিদা (৭) ও তাসদিয়া (১১); একই এলাকার সোহেল খানের মা ফরিদা বেগম (৫৫), স্ত্রী রাইতি আক্তার (৩০), শাশুড়ি রুমি বেগম (৫০) এবং বাবুল মাদবরের স্ত্রী ফাতেমা বেগম (৪০)।

স্ত্রী ও আদরের দুই শিশুসন্তান হারিয়ে পাগলপ্রায় বাবা আবুল কালাম আজাদ। কোনো সান্ত্বনাতেই তাঁর আহাজারি থামছে না। বারবার আবুল কালাম বলে উঠছেন, ‘হায় আল্লাহ, আমার এইয়া কী হইয়া গেল! আমারে তুমি লইয়া যাও। আমি কাদের জন্য বাঁচব, বেঁচে থাকার সবটুকু সম্বল কেড়ে নিলা আল্লাহ। আমার সবকিছু শ্যাষ হইয়া গেল।’

আরও পড়ুন
সোহেলের বাড়ির সামনে লোকজনের ভিড়
ছবি: প্রথম আলো

আবুল কালামের প্রতিবেশী মো. মাসুম হোসেন বলেন, ‍দুর্ঘটনায় নিহত সাতজনই একে অপরের স্বজন। বিয়ের দাওয়াত খেয়ে তাঁদের সবার আনন্দের রেশ নিয়ে আজ রোববার বাড়ি ফেরার কথা ছিল। অথচ শোকের চাদরে ঢেকে দিয়ে লাশ হয়ে ফিরলেন তাঁরা। কোনোভাবেই তাঁদের এই মর্মান্তিক মৃত্যু তাঁরা মানতে পারছেন না। এলাকাজুড়ে বিষাদের ছায়া নেমে এসেছে।

পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, গত শুক্রবার দুপুরে আমতলীর কাউনিয়ার মনিরুল ইসলামের মেয়ে হুমায়রার সঙ্গে একই এলাকার সেলিম ইসলামের ছেলে সোহাগের বিয়ে হয়। শনিবার বউভাতের অনুষ্ঠানে যাওয়ার পথে বরগুনার আমতলী এলাকার হলদিয়া খালের ওপর লোহার ব্রিজ ভেঙে তাঁদের বহনকারী মাইক্রোবাস পানিতে পড়ে যায়। পরে নারী-শিশুসহ ৯ জনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস।

আরও পড়ুন

দুর্ঘটনায় আহত ফজলুর রহমান খানের ছেলে সাবেক সেনাসদস্য মাহবুব খান সবুজের স্ত্রী দিশা জানান, ‘সেতু ভেঙে মাইক্রোবাস খালে পড়ে যাওয়ার পর আমরা জানালার কাচ ভেঙে বের হয়ে আসি। সেতু যখন ভেঙে পড়ে, তখন বলা হলেও ড্রাইভার দরজার লক খুলে দেয়নি। ড্রাইভার নিজে বের হয়ে যায় কিন্তু দরজার লক খোলেনি। মাইক্রোবাসের দরজা খোলা থাকলে আমরা সবাই বেঁচে যেতাম।’

শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, খুবই মর্মান্তিক ঘটনা। তাঁরা খোঁজখবর নিচ্ছেন। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানাজায় শরিক হয়ে তাঁদের প্রত্যেকের দাফন খরচ বাবদ ১০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে।