‘আমার হাত-পা কাইট্টা দেন, তবু আর মাইরেন না’

পিটুনি
প্রতীকী ছবি

নরসিংদীর পলাশ উপজেলায় চোর সন্দেহে দুই কিশোরকে পিটুনির ঘটনায় এক কিশোরের মৃত্যু হয়েছে। গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অন্য কিশোর। তাদের সঙ্গে ঠিক কী ঘটেছিল, জানতে গতকাল রোববার বিকেলে হাসপাতালে গিয়ে বেঁচে ফেরা কিশোরের সঙ্গে কথা হয়।

হতাহত দুই কিশোর সমবয়সী। দুজনের বয়স ১৬। দুজন একই এলাকার বাসিন্দা। তারা সব সময় একসঙ্গে চলাফেরা করত।

বেঁচে ফেরা কিশোরের ভাষ্য, গত শনিবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে তারা উপজেলার একটি টেক্সটাইল মিলের পেছনে খোলা জায়গায় যায়। সেখানে তারা দেড় ঘণ্টা অবস্থানের পর রাত দুইটার দিকে পাশের এলাকার এরশাদ মিয়া ওরফে খুকুর নেতৃত্বে ছয় থেকে সাতজন লোক সেখানে যান। তাঁরা ‘এত রাতে এখানে কী করিস’ বলেই দুজনকে ধরেন। এ সময় পরিচয় দিয়ে দুজন বলে, ‘এমনি এসেছি।’ পরে এরশাদের নির্দেশে তাঁর বাড়ি থেকে একটি দা এনে কাঠের অংশ দিয়ে তাদের একটার পর একটা আঘাত করা হয়। এরপর সবাই মিলে দুজনকে যে যার মতো চড়-ঘুষিসহ উপর্যুপরি মারতে শুরু করেন।

লোকজন লোহা চুরি করতে সেখানে গিয়েছি, এটা স্বীকার করে নেওয়ার জন্য মারধর করেন বলে জানায় ভুক্তভোগী কিশোর। সে বলে, ‘ “যতক্ষণ চুরির কথা স্বীকার না করবি, ততক্ষণ মারব” এ কথা বলেই তাঁরা টেক্সটাইল মিলের একটি পিলারে দুজনকে বেঁধে মারতে থাকেন। একসময় মিলের এক প্রহরী এগিয়ে এসে “এভাবে মারলে তো মরে যাবে” বলে আমাদের ছেড়ে দিতে বলেন। এভাবে এক ঘণ্টা নির্যাতনের পর রাত তিনটার দিকে এরশাদ ও তাঁর লোকজন তাদের টেনেহিঁচড়ে তাঁর বাড়িতে নিয়ে যান।’

মারধরের শিকার ওই কিশোর বলে, ‘এরশাদের বাড়িতে নিয়ে ঘরের সামনে একটি আমগাছের সঙ্গে বাঁধা হয় একজনকে। আর আমাকে বাঁধা হয় একটি সুপারিগাছের সঙ্গে। পরে ওই বাড়ির নারীরাও এসে যোগ দেন। যাঁর হাতে যা ছিল, তাই দিয়েই সবাই মিলে আমাদের মারধর করেন। একপর্যায়ে আমাকে ছেড়ে দিয়ে সবাই মিলে শুধু অন্যজনকে (মৃত কিশোর) মারধর করতে থাকেন। ফজরের আজান দেওয়া পর্যন্ত তাকে সবাই মিলে মারে। একপর্যায়ে অন্যজন (মৃত কিশোর) তাদের বলে, “আমার হাত-পা কাইট্টা দেন, তবু আর মাইরেন না।” এ সময় সে অচেতন হয়ে গেলে “অভিনয় করছে” বলে তাকে আরেক দফা মারা হয়। ফজরের আজানের পরপরই তাঁর মৃত্যু হয়।’

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন কিশোর বলে, একজনের মৃত্যু হয়েছে বুঝতে পেরে তাকে অন্যত্র সরিয়ে ফেলেন তাঁরা। সবাই মিলে পরামর্শ করে তার লাশ একটি বস্তায় ভরে টেক্সটাইল মিলের দেয়ালের ওপর দিয়ে ভেতরে ফেলে দেন। পরিচিত একজন ওই পথ ধরে যাওয়ার সময় তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠান। পরে ঘটনাটি জানাজানি হলে পুলিশ ওই কিশোরের লাশ উদ্ধার করে।

আক্ষেপ করে ওই কিশোর বলে, ‘এত রাতে সেখানে যাওয়া হয়তো ঠিক হয়নি, কিন্তু আমরা চুরি করতে সেখানে যাইনি। চুরির অপবাদ দিয়ে এভাবে মানুষ মারা ঠিক?’

এত রাতে সেখানে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে ওই কিশোর কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি। তবে স্বজন ও স্থানীয় লোকজন জানান, টেক্সটাইল মিলের খোলা জায়গায় স্থানীয় কিশোর-তরুণেরা প্রায় সময় নেশা করেন। গতকাল রাতে ওই দুই কিশোরও হয়তো এমন কোনো কারণেই সেখানে গিয়েছিল।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, শনিবার দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে দুই কিশোর টেক্সটাইল মিলসংলগ্ন জঙ্গলে যায়। এ সময় চোর সন্দেহে দুই কিশোরকে আটক করেন এরশাদ মিয়া (৩০) নামের একজন। আজ ভোর পর্যন্ত এরশাদ ও তাঁর স্বজনেরা দুই কিশোরকে আটকে রেখে পিটুনি দেন। এতে ঘটনাস্থলে এক কিশোরের মৃত্যু হয়। পরে আহত অবস্থায় আরেক কিশোরকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। খবর পেয়ে ঘোড়াশাল পুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক (এসআই) মাজিদ হোসেন ঘটনাস্থলে গিয়ে কিশোরের লাশ উদ্ধার করেন।

জানতে চাইলে পলাশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ ইলিয়াছ জানান, হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এখনো মামলা করতে থানায় আসেননি নিহত কিশোরের স্বজনেরা। তবে হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে ঘটনাস্থল ও আশপাশের এলাকা থেকে সাতজনকে আটক করেছে পুলিশ। এরশাদ মিয়া পলাতক। তাঁকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। লিখিত অভিযোগ পেলেই মামলা নেওয়া হবে।

আরও পড়ুন