গাজীপুরে রানির ভিটায় পাওয়া গেল মধ্যযুগের স্মৃতিচিহ্ন

গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার দরদরিয়া গ্রামে রানির ভিটায় সুলতানী আমলের স্মৃতিচিহ্ন পাওয়া গেছে। শুক্রবার বিকেলেছবি: প্রথম আলো

গাজীপুরের কাপাসিয়ার দরদরিয়া গ্রামে প্রত্নতাত্ত্বিক খননে দুষ্প্রাপ্য ও তাৎপর্যপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। নদী, দ্বি-স্তর দুর্গ, জঙ্গল ও ভূরাজনৈতিক অবস্থান মিলিয়ে এক মাসের অনুসন্ধান ও গবেষণা থেকে দুর্গটি সুলতানি আমলে নির্মিত হয়েছিল বলে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন প্রত্নতাত্ত্বিকেরা।

প্রত্নতাত্ত্বিক খনন নিয়ে আজ শুক্রবার বিকেলে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়। সরকারের মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী সিমিন হোসেন রিমি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে ছিলেন।

আরও পড়ুন

এর আগে গত ২৬ ডিসেম্বর দরদরিয়া গ্রামে রানির ভিটা হিসেবে পরিচিত একডালা দুর্গে খননকাজ শুরু করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি ‘ঐতিহ্য অন্বেষণ’ নামে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণাকেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক। খনন শুরুর ২৫ দিনের মাথায় একডালা দুর্গের ইতিহাস উন্মোচন হতে থাকে। ইট, গ্লেজড মৃৎপাত্র, নলযুক্ত বিশেষ মৃৎপাত্র, সাধারণ মৃৎপাত্রসহ নানা বস্তু আবিষ্কৃত হয়।

খনন-সংশ্লিষ্টদের সূত্রে জানা গেছে, দরদরিয়া গ্রামের একটি নির্দিষ্ট স্থানে সাতটি খাদ খনন করে গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতত্ত্ব বস্তু ও তথ্য-উপাত্ত আবিষ্কার করা হয়। প্রাথমিক অবস্থায় দুর্গের আকার, পরিমাপ ও কিছু বস্তু আবিষ্কৃত হয়েছে। দুর্গের আকার অর্ধচন্দ্র আকৃতির। সেখানে দুর্গ-প্রাচীর ও পরিকল্পিত পরিখা আছে। দুর্গের পূর্ব দিকে অর্ধচন্দ্রের পরিধিব্যাপী পরিখা ও পশ্চিমে বানার নদ। আবিষ্কৃত দেয়ালের একটি অংশে দুর্গ-প্রাচীরের ‘বুরুজ’ পাওয়া গেছে। দুর্গ-প্রাচীরের সঙ্গে সংযুক্ত বুরুজটি অর্ধবৃত্তাকার। দুর্গের ভেতর থেকে বুরুজে ওঠার চিহ্নও পাওয়া গেছে। বুরুজ অংশে একটি মাটির বল আবিষ্কার হয়। এটি প্রাচীনকালে ঐতিহ্যবাহী পোড়ামাটির গোলকের ব্যবহার স্মরণ করিয়ে দেয়। এ ধরনের বস্তু উয়ারী-বটেশ্বরেও পাওয়া গেছে। বুরুজের অন্য প্রান্তে (উত্তর পাশে) কোনো দেয়ালের অংশ নেই। সেখানে চুন-সুরকির ঢালাইয়ের চিহ্ন পাওয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, দুর্গ-প্রাচীরের পূর্ব দিকে একটি প্রবেশদ্বার বা তোরণ ছিল।

আরও পড়ুন

দুর্গের নিরাপত্তাব্যবস্থা সম্পর্কে চমকপ্রদ তথ্য পেয়েছেন গবেষকেরা। খনন-সংশ্লিষ্টরা জানান, দুর্গটি প্রকৃতি ও মানবসৃষ্ট পরিখার এক দারুণ কৌশলগত প্রতিরক্ষাব্যবস্থা। অর্ধচন্দ্রাকৃতির দুর্গের পরিধি অংশের দুর্গ-প্রাচীরের দৈর্ঘ্য ৫৫০ মিটার এবং নদীর দিকে সরলরেখায় দুর্গ-প্রাচীরের দৈর্ঘ্য ৩৩০ মিটার। দুর্গের অভ্যন্তরে সমতল ভূমি থেকে ২ মিটার নিচ পর্যন্ত প্রত্নতাত্ত্বিক খননে মানববসতির চিহ্ন বা আলামত পাওয়া গেছে। দুর্গ-প্রাচীরের মতো সেখানে পাওয়া বুরুজটি ভিত্তি থেকে ৮৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত ইটের গাঁথুনি টিকে আছে। সামরিক দিক বিবেচনায় বুরুজটি খুবই কৌশলগত স্থাপনা বলে ধারণা করা হচ্ছে।

খননে পাওয়া স্থাপনার আকৃতি সম্পর্কে বলা হয়, দুর্গ-প্রাচীরটি দুই দফায় নির্মাণ করা হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, প্রথম নির্মাণ পর্বে ভিত্তিসহ নিয়মিত ইটের গাঁথুনির দেয়াল ৬৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। ইটের টুকরা ও মাটিমিশ্রিত পদার্থ দিয়ে নির্মিত দেয়াল পাওয়া গেছে ১৪৫ সেন্টিমিটার। তবে দুর্গ-প্রাচীরের ওপরের অংশ ধ্বংস হয়ে গেছে।

আপেক্ষিক তারিখ নির্ণয় পদ্ধতিতে আবিষ্কৃত ইট, ইটের পরিমাপ, গ্লেজড মৃৎপাত্র, নলযুক্ত বিশেষ মৃৎপাত্রের ভিত্তিতে ধারণা করা হচ্ছে, দুর্গটি সুলতানি যুগের
ছবি: প্রথম আলো

প্রাথমিক জরিপে দুর্গের অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু ফিচার সম্পর্কে ধারণা পাওয়া গেছে। দুর্গ-প্রাচীরের পরিমাপ প্রায় ২ কিলোমিটার। নদীতে মিলিত দুর্গ-প্রাচীরের দুই প্রান্তের দূরত্ব সরল রেখায় প্রায় ১ হাজার ৪০০ মিটার। প্রায় ২ কিলোমিটার বহিঃস্থ দুর্গ-প্রাচীরটির কোনো কোনো জায়গা প্রায় ৪০ মিটার প্রশস্ত এবং প্রায় ৫ মিটার উঁচু। দুর্গ-প্রাচীরের বাইরের দিকে ভূমির গঠন বাইদ ও চালা প্রকৃতির এবং আছে গজারি বনজঙ্গল।

প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষকেরা জানান, দরদরিয়া দুর্গের সময়কাল গবেষণাধীন। এ বিষয়ে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে আপেক্ষিক তারিখ নির্ণয় পদ্ধতিতে আবিষ্কৃত ইট, ইটের পরিমাপ, গ্লেজড মৃৎপাত্র, নলযুক্ত বিশেষ মৃৎপাত্র, সাধারণ মৃৎপাত্রের ভিত্তিতে ধারণা করা হচ্ছে দুর্গটি সুলতানি যুগের।

শুক্রবার বিকেলে দরদরিয়া গ্রামের দুর্গের পাশে একটি জমিতে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ঐতিহ্য অন্বেষণের সভাপতি নুহ-উল-আলম। প্রধান অতিথি ছিলেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী সিমিন হোসেন রিমি। অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেসবাহ কামাল, কাপাসিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক আফরোজা খান প্রমুখ।

ঐতিহ্য অন্বেষণের নির্বাহী পরিচালক সুফি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এটি পরিকল্পিত একটি দুর্গ। এর একদিকে নদী অন্যদিকে বন। দুর্গের সঙ্গে মধ্যযুগের আরেকটি দুর্গের কথা বলা হয়, যেটি একডালা দুর্গ। যেখানে দিল্লির সুলতান এসে বাংলার সুলতানকে আক্রমণ করেছিলেন। এখানে অবস্থান করে নিজেকে রক্ষা করেছিলেন। কিন্তু জয় করতে পারেনি। সে জন্য আরেকটি দিক থেকে প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাসে এটি স্বাধীনতার প্রতীক। তিনি বলেন, জরিপ ও খনন শেষে দুর্গটি সংরক্ষণ করা হলে অসাধারণ একটি পর্যটনকেন্দ্র হবে।

প্রত্নতাত্ত্বিক খনন নিয়ে আজ শুক্রবার বিকেলে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়। সরকারের মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী সিমিন হোসেন রিমি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে ছিলেন
ছবি: প্রথম আলো

ঐতিহ্য অন্বেষণের সভাপতি নুহ-উল-আলম বলেন, শতবর্ষ আগে থেকেই দুর্গের কোনো কোনো অংশ উন্মুক্ত ছিল। সবাই এটিকে রানির বাড়ি মনে করতেন। তখন থেকেই জায়গাটি রানির বাড়ি হিসেবে পরিচিতি পায়। কিন্তু এটা নিয়ে কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা হয়নি। তাঁরা ডিসেম্বর থেকে প্রথম খনন শুরু করেন। এক মাসের অনুসন্ধান ও গবেষণা থেকে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন, দ্বাদশ শতাব্দীতে দুর্গটি নির্মিত হয়েছিল। সুলতানি আমলে। প্রত্নতাত্ত্বিক কৌশল ও বিবরণ থেকে ধারণা করা হচ্ছে, দুর্গটি চন্দ্রাকৃতির।

প্রতিমন্ত্রী সিমিন হোসেন রিমি বলেন, ‘আজ আমরা একটা স্বপ্ন স্পর্শ করলাম। এটা বিশ্বঐতিহ্য হিসেবে পরিচিতি পাবে। দেশের পর্যটনকে আকৃষ্ট করতে প্রত্নতাত্ত্বিক বিষয়গুলোকে পর্যটনের সঙ্গে থাকা উচিত। বিশ্বের অন্যান্য দেশে পর্যটন দিয়ে বিরাট রাজস্ব আয় করে। প্রত্নতত্ত্ব থেকে মানুষের জ্ঞানও অর্জন হয়। এটি দেশের জন্য উল্লেখযোগ্য প্রত্নতত্ত্ব আবিষ্কার।’  

বাংলাদেশের মধ্যযুগের ইতিহাসে ‘একডালা দুর্গের’ অবস্থান নির্ণয় একটি অমীমাংসিত বিষয়। মধ্যযুগে ‘একডালা দুর্গের’ অস্তিত্ব ছিল। এ বিষয়ে কোনো বিতর্ক নেই। কারণ, দিল্লির সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলকের সমসাময়িক ইতিহাসবিদ জিয়াউদ্দীন বারাণীর ‘তারিখ-ই-ফিরোজশাহী’ গ্রন্থে একডালা দুর্গের উল্লেখ আছে।