দিনভর মর্টার শেলের বিস্ফোরণে কাঁপল টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন দ্বীপ

নাফ নদীতে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের সদস্যরা। টেকনাফের লেদা সীমান্তেফাইল ছবি: জুয়েল শীল

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে মর্টার শেল, গ্রেনেড-বোমার বিস্ফোরণ কিছুতেই থামছে না। আজ মঙ্গলবার ভোর পাঁচটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত রাখাইন রাজ্যের মংডু টাউনশিপের উত্তর ও দক্ষিণ দিকের সাতটি গ্রামে শতাধিক মর্টার শেল ও অসংখ্য শক্তিশালী গ্রেনেড-বোমার বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া গেছে।

ওপারের বিস্ফোরণের বিকট শব্দে এপারের টেকনাফের হ্নীলা, হোয়াইক্যং, টেকনাফ পৌরসভা, সাবরাং ইউনিয়ন ও সেন্ট মার্টিন দ্বীপে ভূকম্পন টের পেয়েছেন স্থানীয় লোকজন। এর আগে সোমবার সকাল ১০টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত ওই সব গ্রামে আরও অর্ধশতাধিক মর্টার শেল বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পান টেকনাফের মানুষ।

সীমান্তের একাধিক সূত্র জানায়, দীর্ঘ দুই মাস ধরে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে দেশটির সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) সংঘাত চলছে। সীমান্তসংলগ্ন বেশ কয়েকটি এলাকায় আরাকান আর্মি নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার দাবি করেছে। ইতিমধ্যে মংডুর উত্তর-দক্ষিণের কয়েকটি সীমান্তচৌকি ও পূর্ব দিকের রাচিডং টাউনশিপসহ ১২টির বেশি সীমান্তচৌকি ও পুলিশ ফাঁড়ি দখল করে নিয়েছে আরাকান আর্মি। কয়েক দিন ধরে বুচিডং ও মংডু টাউনশিপ দখলে মরিয়ে হয়ে উঠেছে আরাকান আর্মি। আরাকান আর্মির অবস্থান ধ্বংস এবং দখল করা চৌকিসমূহ পুনরুদ্ধার ও এলাকাগুলোতে নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে মরিয়া দেশটির সেনাবাহিনী। এ জন্য সংঘাত বাড়ছে। মাঝেমধ্যে বিমান ও হেলিকপ্টার থেকেও মর্টার শেল, গ্রেনেড বোমা নিক্ষেপ করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন

স্থানীয় লোকজন জানান, মঙ্গলবার ভোর পাঁচটার দিকে মংডু টাউনশিপের উত্তরে বলিবাজার, কাওয়ারবিল, পেরাংপুরু ও নাকফুরা এলাকাতে দুই বাহিনীর পাল্টাপাল্টি হামলা ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। সেখানে দেশটির সেনাবাহিনীর ব্যারাক ও সীমান্তরক্ষী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) সেক্টর রয়েছে। বেলা ১১টা দিকে দুই পক্ষের এই সংঘাত-লড়াই মংডুর দক্ষিণে হাস্যুরাতা ও আশপাশে দুটি গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। থেমে থেমে এই সংঘর্ষ সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত চলতে থাকে। হাস্যুরাতার বিপরীতে বঙ্গোপসাগরে মধ্যে টেকনাফের সেন্ট মার্টিন দ্বীপের অবস্থান। ওপারের বিকট শব্দের বিস্ফোরণে টেকনাফের পাশাপাশি সেন্ট মার্টিন দ্বীপেও ভূকম্পন দেখা দেয়।

আরও পড়ুন

দ্বীপের বাসিন্দা ও স্থানীয় সংবাদকর্মী নূর মোহাম্মদ বলেন, মঙ্গলবার সকালে হঠাৎ করে একের পর এক বিকট শব্দে কেঁপে উঠছে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ। বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত মর্টার শেলের ওই বিস্ফোরণ শোনা গেছে। তাতে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন দ্বীপের মানুষ।

সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, কয়েক দিন বন্ধ থাকার পর হঠাৎ আজ মঙ্গলবার সারা দিন ওপারে ২৫-৩০টি মর্টার শেলের বিস্ফোরণ শোনা গেছে, এতে পুরো দ্বীপ কেঁপে ওঠে। তাতে পুরো দ্বীপের মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েন।

সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মোহাম্মদ শরীফ ও হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য শাহ জালাল বলেন, ওপারে মর্টার শেলের বিস্ফোরণ দিন দিন বাড়ছে। টানা দুই মাস ধরে টেকনাফ উপজেলার সাত হাজার জেলে নাফ নদীতে মাছ শিকারে নামতে পারছেন না। নাফ নদীর তীরের জমিতে ধান-শাকসবজির চাষ, মৎস্য ও কাঁকড়া আহরণ করতে পারছেন না আরও সাত হাজার কৃষক-শ্রমিক। চরম অর্থসংকটে সীমান্তের হাজারো মানুষ পবিত্র রমজান মাস অতিক্রম করলেও শান্তিতে ঈদ উদ্‌যাপন নিয়ে চিন্তিত।

আরও পড়ুন

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী বলেন, ওপারের দুই মাসের সংঘাতে টেকনাফ সীমান্তের লোকজন আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। কিছুদিন বন্ধ থাকার পর নতুন করে মর্টার শেলের বিস্ফোরণে টেকনাফের কয়েকটি গ্রাম কেঁপে উঠছে।

সীমান্তের একাধিক সূত্র জানায়, শক্তিশালী আরাকান আর্মির সঙ্গে কয়েকটি এলাকায় টিকতে পারছে না সরকারি বাহিনী। জীবন বাঁচাতে সরকারি বাহিনীর বেশ কিছু সদস্য চৌকি-ব্যারাক ফেলে মংডুর পূর্ব দিকের কালাদান পাহাড়ে আত্মগোপন করছেন। সর্বশেষ গত ৩০ মার্চ মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ৩ সদস্য সীমান্ত অতিক্রম করে নাইক্ষ্যংছড়ির বাংলাদেশ ভূখণ্ডে আশ্রয় নেন। এর আগে ১১ মার্চ আশ্রয় নেন আরও ১৭৭ জন বিজিপি ও সেনাসদস্য। তাঁরা সবাই নাইক্ষ্যংছড়ি সদরে ১১ বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) হেফাজতে রয়েছেন। এর আগে কয়েক দফায় বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিলেন আরও ৩৩০ জন। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ৩৩০ জনকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছিল।

টেকনাফ ২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, অনুপ্রবেশ ঠেকাতে নাফ নদী ও সীমান্তে বিজিবির টহল বাড়ানো হয়েছে। রাখাইন পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন