ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে হারলেন বেপরোয়া গতির ট্রাকের কাছে

সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত তনছের আলী, তাঁর ছেলে ফজলে রাব্বী এবং রাব্বীর বন্ধু আবদুর রহমান (সবার ডানে)
ছবি: সংগৃহীত

৯ মাস আগে তনছের আলীর (৭৫) ফুসফুসে ক্যানসার ধরা পড়ে। এরপর বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কেমোথেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসা চলছিল। তিন সপ্তাহ পর পর কেমোথেরাপি চলছিল। ঈদের আগেই থেরাপি নেওয়ার তারিখ নির্ধারিত ছিল। কিন্তু তনছের আলী হঠাৎ শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর আজ শনিবার ক্যানসারে আক্রান্ত বাবাকে নিয়ে ছোট ছেলে ফজলে রাব্বি ওরফে টগর (২৫) বগুড়ায় আসছিলেন।

নওগাঁর ধামুইরহাট পৌর এলাকার জগদল গ্রামে তনছের আলীর বাড়ি। তাঁর ছোট ছেলে ফজলে রাব্বি তাঁকে নিয়ে আজ রওনা দিয়েছিলেন বন্ধু আবদুর রহমানের (৩২) ভাড়া করা গাড়িতে। পাশের গ্রামেই আবদুর রহমানের বাড়ি। আবদুর রহমান ট্রাক কেনার জন্য ভাড়ায় চালিত একটি প্রাইভেট কারে বগুড়ায় যাচ্ছিলেন। বন্ধুর অসুস্থ বাবাকে তুলে নিতে আজ ভোরে রাব্বির বাড়িতে সেই গাড়ি পাঠানো হয়। সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে বাবাকে নিয়ে রাব্বি বন্ধুর ভাড়া করা গাড়িতে রওনা দেন বগুড়ার উদ্দেশে। পথিমধ্যে গাড়িতে ওঠেন বন্ধু আবদুর রহমান ও আরেক বন্ধু শাকিল। তবে শহরে পৌঁছা হয়নি কারও।

আরও পড়ুন
দুমড়েমুচড়ে যাওয়া ভাড়ায় চালিত প্রাইভেটকার। কাহালু উপজেলার কালিয়ার পুকুর এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

বগুড়ায় পৌঁছার আগেই সকাল আটটার দিকে বগুড়া-নওগাঁ মহাসড়কের কাহালু উপজেলার দরগাহাটসংলগ্ন কালিয়ার পুকুর এলাকায় বিপরীতমুখী একটি বেপরোয়া ট্রাকের ধাক্কায় তাঁদের প্রাইভেট কারটি দুমড়েমুচড়ে যায়। কাহালু থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আমবার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, প্রাইভেট কারের চালক সুমন, যাত্রী তনছের আলী ও তাঁর ছেলে ফজলে রাব্বি ঘটনাস্থলেই নিহত হন। কারে থাকা আহত দুই যাত্রী আবদুর রহমান ও শাকিলকে উদ্ধার করে বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক আবদুর রহমানকে মৃত ঘোষণা করেন।

নিহত তনছের আলী ধামুইরহাট সদর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। অন্যদিকে তাঁর ছেলে ফজলে রাব্বি কৃষিকাজ করতেন। তাঁর বন্ধু একই উপজেলার চকযদু গ্রামের আবদুর রহমান বালুর ব্যবসা করতেন। প্রাইভেট কারের চালক সুমনের (৩০) বাড়ি নওগাঁর পত্নীতলা উপজেলার গুচ্ছগ্রামে।

প্রাইভেট কারটিকে ধাক্কা দেওয়া ট্রাকটি
ছবি: প্রথম আলো

দুর্ঘটনার পর ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা নিহত চারজনের লাশ উদ্ধার করে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজের মর্গে নেন। লাশঘরের সামনে কথা হয় নিহত ব্যক্তিদের স্বজনদের সঙ্গে। বাবা তনছের আলী ও ছোট ভাই ফজলে রাব্বি নিহত হওয়ার খবর শোনার পর হাসপাতালের সামনে ছুটে এসেছেন জাহাঙ্গীর আলম। তিনি জয়পুরহাটের ভুটিয়ামারি উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক।

জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ২১ দিনের মাথায় কেমোথেরাপি নিতে হতো বাবাকে। সেই হিসাবে ঈদের আগেই থেরাপি নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শারীরিকভাবে তিনি বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিছুটা সুস্থ হলে আজ থেরাপি নিতে বাবাকে নিয়ে বগুড়ায় রওনা দেন ছোট ভাই ফজলে রাব্বি। পথে ট্রাক দুজনকেই কেড়ে নিল।

নিহত ফজলে রাব্বির স্ত্রী সোমা বেগম বলেন, ‘ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করেই আমার শ্বশুর ৯ মাস ধরে বেঁচে ছিলেন। কিন্তু দানব ট্রাকের কারণে বাঁচতে পারলেন না। আমি অল্প বয়সে স্বামীহারা হয়ে গেলাম। এখন দুই বছর বয়সী আমার অবুঝ মেয়েটা বাবা বাবা করে কাঁদছে। অবুঝ মেয়েটাকে কী বলে সান্ত্বনা দেব?’

আবদুর রহমান বালুর ব্যবসা করতেন। ভাড়া করা ট্রাকে বালু সরবরাহ করতে খরচ বেশি পড়ত। এ কারণে ট্রাক কেনার স্বপ্ন ছিল তাঁর বহুদিনের। তাঁর বাবা মফিজ উদ্দিন বলেন, ব্যবসার জন্য কিস্তিতে ট্রাক কেনার স্বপ্নপূরণ করতে ১৮ লাখ টাকা জোগাড় করেন আবদুর রহমান। আজ একটি প্রাইভেট কার ভাড়া করেন বগুড়া যাওয়ার জন্য। সঙ্গে নেন ১৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে এক বন্ধু ও তাঁর অসুস্থ বাবাকেও কারে তুলে নেন। তবে বগুড়ায় পৌঁছার আগেই সবাই নিহত হয়েছেন। আবদুর রহমানের সঙ্গে থাকা ১৮ লাখ টাকাভর্তি ব্যাগের হদিস মেলেনি এখনো। মফিজ উদ্দিন বলেন, ‘দুই বছর আগে রহমানকে বিয়ে দিয়েছি। এখনো সন্তান হয়নি। বাবা হয়ে ছেলের এই মর্মান্তিক মৃত্যুর শোক সইব কীভাবে?’