২০ বছর ধরে পতাকা বিক্রি করছেন ধীরেন সরকার

শরীয়তপুরের বিভিন্ন সড়কে পতাকা নিয়ে ঘুরছেন ধীরেন সরকার। গতকাল মঙ্গলবার রাতে জেলা শহরের সদর রোডে
ছবি: প্রথম আলো

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ১০ বছরের শিশু ছিলেন ধীরেন সরকার। এখন তাঁর বয়স ৬২ বছর। ছোটকালে দেখা যুদ্ধের অনেক স্মৃতি এখনো তাঁর মনকে নাড়া দেয়। অবসরে গ্রামের হাটবাজারের চায়ের দোকানে তরুণদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের নানা স্মৃতি নিয়ে গল্প করেন তিনি। আর স্বাধীনতা ও বিজয়ের মাস শুরু হলেই জাতীয় পতাকা বিক্রি করার জন্য বেরিয়ে পড়েন পথে। দিন-রাত গ্রামে ও শহরের অলিগলিতে ঘুরে পতাকা বিক্রি করেন। ২০ বছর ধরে এ কাজ করছেন তিনি।

ধীরেন সরকারের বাড়ি মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার বহেরাতলা গ্রামে। তিনি ওই গ্রামের মৃত হীরালাল সরকারের ছেলে। বিজয়ের মাস এসে গেছে। এক সপ্তাহ ধরে শরীয়তপুরের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে পতাকা বিক্রি করছেন তিনি। ধীরেন সরকার গত মঙ্গলবার শরীয়তপুর শহরের সদর রোডের একটি চায়ের দোকানে বসে মুক্তিযুদ্ধের নানা বিষয় নিয়ে স্মৃতিচারণা করেন। তখন তাঁর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিনিধির।

ধীরেন বলেন, ২০ বছর ধরে মার্চ আর ডিসেম্বর মাস এলে পতাকা বিক্রি করেন। ছোট ছোট ছেলে-মেয়ের হাতে পতাকা পৌঁছে দিতে পেরে আনন্দে ভরে যায় তাঁর মন। আগে অবসরে নিজেই বাড়িতে বসে পতাকা তৈরি করতেন। এখন আর নিজে তৈরি করেন না। ঢাকা থেকে কিনে আনেন। মার্চ মাসে ১৫ দিন আর ডিসেম্বর মাসে ১৫ দিন তিনি অন্য কোনো কাজ রাখেন না। বছরের এই ৩০ দিন ঘুরে ঘুরে পতাকা বিক্রি করেন।

দুই মেয়ে, এক ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে ধীরেন সরকারের সংসার। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। ছেলে ঢাকায় গ্যারেজ চালান। ধীরেন স্ত্রীকে নিয়ে নিজের জমি চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করেন।

আরও পড়ুন

ধীরেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি ছোট মানুষ। তেমন কিছুই বুঝি না। তবে তখনকার অনেক স্মৃতি মনে আছে। গ্রামের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া, মানুষের লাশ পড়ে থাকা দেখেছি। লুটপাটের শিকার হয়ে আত্মীয়স্বজনেরা সবকিছু ফেলে দেশ ছেড়েছেন—তা–ও দেখেছি। পালিয়ে কিছু স্বজন মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন। আবার তাঁরা অস্ত্র হাতে ফিরে এসেছেন। কিন্তু আমাদের পরিবার গ্রাম ছাড়েনি। মা-বাবা আমাদের ছোট ভাই-বোনদের নিয়ে বাগানে, ফসলি জমিতে, পদ্মার চরের বিভিন্ন স্থানে পালিয়ে থেকেছেন। এমনও দিন গেছে, খাবার পাইনি, রাতে ঘুমাতে পারিনি। খিদে লাগলেও আওয়াজ করে কাঁদতে পারিনি ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে।’

ধীরেন আরও জানান, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর লাল-সবুজের পতাকা নিয়ে বিজয় উৎসব দেখেছেন। তখনই বুঝেছেন, এই পতাকার জন্যই দেশের মানুষ এত কষ্ট করেছেন, রক্ত দিয়েছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নানা রাজনৈতিক উত্থান-পতন দেখেছেন। সংসারের নানান বাস্তবতায় আগে এসব নিয়ে সময় দিতে পারতেন না। এখন ছেলে-মেয়েরা বড় হয়েছে। কিছুটা অবসর সময় বের করতে পারেন। তাই তো নতুন প্রজন্মের সামনে জাতীয় পতাকার মাহাত্ম্য তুলে ধরতে পথে নেমেছেন। যত দিন বেঁচে থাকবেন, এভাবেই লাল-সবুজের জাতীয় পতাকা নিয়ে নতুন প্রজন্মের কাছে হাজির হবেন।

আরও পড়ুন

শিবচরের বহেরাতলা দক্ষিণ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল বারি উকিল মুঠোফোনে বলেন, ধীরেন সরকারের পরিবারের সদস্যেরা মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক ত্যাগ শিকার করেছেন। তাঁদের অনেক আত্মীয়স্বজন মুক্তিযোদ্ধা। ধীরেন স্বাধীনতা ও বিজয়ের মাস শুরু হলেই জাতীয় পতাকা নিয়ে পথে পথে ঘোরেন। তিনি আয় করার জন্য এটা করেন না। দেশের প্রতি ভালোবাসা ও আবেগ থেকে তিনি এটি করেন। লাল-সবুজের পতাকা নিয়ে এমন আবেগ তিনি খুব কম মানুষের মধ্যে দেখেছেন।