‘আমার মেয়েটা আর কোনো দিন বাবা ডাকতে পারবে না’

স্বামী রামকৃষ্ণের মৃত্যুর খবরে হাসপাতালে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন বৃষ্টি সরকার ও স্বজনেরা। মঙ্গলবার দুপুর টঙ্গীর শহীদ আহসান উল্লা মাস্টার জেনারেল হাসপাতালেছবি: প্রথম আলো

তখনো স্ত্রী বৃষ্টি সরকার আসেননি। হাসপাতালের বারান্দায় পড়ে আছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক রামকৃষ্ণের মরদেহ। তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, শিক্ষক, পুলিশ ও হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা অন্যান্য মানুষ। খবর পেয়ে এরই মধ্যে পাগলের মতো ছুটে এসেছেন শ্যালক সরণ সরকার। একমাত্র বোনজামাইয়ের নিথর দেহ দেখে তিনি পাগলপ্রায়। উদ্দেশ্যহীনভাবে ছোটাছুটি করছেন হাসপাতালের বারান্দায়। কাঁদছেন অঝোরে।

বেলা ১টা ০৮ মিনিট। বৃষ্টি এলেন। সঙ্গে আরও কয়েকজন স্বজন। বৃষ্টির চোখেমুখে রাজ্যের হতাশা। দূর থেকে স্বামীর মরদেহ দেখেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরে পেয়ে তিনি উঠে দাঁড়ান। ধীরে ধীরে এগিয়ে যান স্বামীর মাথার কাছে।

আরও পড়ুন

‘এই রাম, তুমি এখানে কেন? তোমার তো এতক্ষণে বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকার কথা। আর তোমার কী হইছে, তোমার মাথায় রক্ত কেন? কথাইবা বলছ না কেন তুমি, এই রাম...’ বলেই অঝোরে কাঁদতে শুরু করেন বৃষ্টি। সেই কান্না একটু একটু করে ছড়িয়ে পড়ে রামকৃষ্ণের বিশ্ববিদ্যালের শিক্ষার্থী, সহকর্মী, স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের চোখে।

রামকৃষ্ণ সাহা গাজীপুরের শিমুলতলীতে অবস্থিত ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ডুয়েট) স্থাপত্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। মঙ্গলবার নিজ বাসা ঢাকার মোহাম্মদপুর থেকে ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেলে করে কর্মস্থল ডুয়েটে যাওয়ার সময় টঙ্গীর চেরাগআলী এলাকায় বাসচাপায় তিনি মারা যান। মারা যান মোটরসাইকেলের চালকও। দুপুর ১২টায় ঘটনাস্থল থেকে লাশ উদ্ধার করে টঙ্গীর শহীদ আহ্‌সান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যায় পুলিশ। খবর পেয়ে সেখানে ছুটে যান বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থী, সহকর্মী, রামকৃষ্ণের স্ত্রী, স্বজন, বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা। এতে কিছু সময়ের জন্য পুরো হাসপাতালে শুরু হয় মাতম। রামকৃষ্ণ সম্পর্কে প্রথম আলোর শেরপুর জেলা প্রতিনিধি দেবাশীষ সাহা রায়ের খালাতো শ্যালক।

বোনের স্বামীর মৃত্যুর খবর পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন সরণ সাহা। মঙ্গলবার দুপুরে টঙ্গীর শহীদ আহসান উল্লা মাস্টার জেনারেল হাসপাতালে
ছবি: প্রথম আলো

বৃষ্টি সরকার কেঁদেই চলেছেন। কখনো জরুরি বিভাগের বারান্দায় চেয়ারে বসে, কখনো স্বামীর মৃতদেহের পাশে দাঁড়িয়ে, কখনো স্বজনদের জড়িয়ে ধরে। তাঁর সঙ্গে কথা বলার অবস্থা নেই। বারবার চিৎকার করে বলছিলেন, ‘আমার স্বামীকে ওরা হত্যা করেছে। ঘাতক বাস আমার স্বামীকে চাপা দিয়ে মারছে। আমি স্বামীহারা হলাম। আমার একমাত্র মেয়ে আর কোনোদিন বাবা ডাকতে পারবে না। ভগবান, আমি এ অন্যায়ের বিচার চাই।’

রামকৃষ্ণের শ্যালক সরণ সরকার জানান, রামকৃষ্ণ তাঁর বোন বৃষ্টিকে নিয়ে মোহাম্মদপুরের চাঁদ হাউজিং এলাকায় বসবাস করতেন। তাঁদের দুই বছরের একটি শিশুসন্তান আছে। নাম ঐশী সাহা। তাঁর ভগ্নিপতি প্রতিদিন মোহাম্মদপুর থেকে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিতেন। যাতায়াত করতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব পরিবহনে। কিন্তু মঙ্গলবার সকালে তিনি কোনো কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস ধরতে পারেননি। এ কারণে ভাড়ার মোটরসাইকেলে যাচ্ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বাসচাপায় মারা যান তিনি।

বিলাপ করতে করতে সরণ সরকার বলছিলেন, ‘আমার একটিমাত্র বোন। তাঁদের ঘরে একটা ফুটফুটে বাচ্চা। সুখের সংসার। কিন্তু একমুহূর্তেই সব শেষ হয়ে গেল। আমাদের সব শেষ।’

প্রিয় শিক্ষক হারানোর শোকে কাতর বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরাও। খবর পেয়ে দুর্ঘটনার পরপরই তাঁরা ছুটে আসেন হাসপাতালে। রামকৃষ্ণের স্ত্রী, পরিবার বা স্বজনদের মতো তাঁরা ফেলছিলেন চোখের পানি। করছিলেন নানা স্মৃতিচারণা।
স্থাপত্য বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ফাহিম মোনায়েম বলছিলেন, ‘প্রতিদিন ক্লাস শুরুর আগে আমরা স্যারকে ফোন দিয়ে জানি, স্যার কোথায় আছেন বা কখন আসবেন। এরই ধারাবাহিকতায় আজও বেলা সাড়ে ১১টার পর আমরা স্যারকে ফোন দিই, কিন্তু স্যারের ফোন অন্য আরেকজন ধরে জানালেন, স্যার অ্যাক্সিডেন্ট করেছেন। স্যার হাসপাতালে আছেন। পরে আমরা কয়েকজন দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাসপাতালে চলে আসি। কিন্তু এসে দেখি স্যার আর নেই।’

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, রামকৃষ্ণ মোহাম্মদপুর থেকে দিদারুল আলম নামের একজনের মোটরসাইকেল ভাড়া করেন। তাঁদের মোটরসাইকেলটি উত্তরার সাইদগ্র্যান্ড সেন্টারের সামনে থেকে বিআরটি প্রকল্পের উড়ালসড়ক ধরে শিমুলতলীর দিকে যাচ্ছিল। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে তাঁদের মোটরসাইকেলটি টঙ্গীর চেরাগ আলী এলাকায় পৌঁছালে সামনে থেকে আসা প্রভাতি-বনশ্রী পরিবহন নামের একটি বাস তাঁদের মোটরসাইকেলটি চাপা দেয়। এতে গুরুতর আহত হন দুজন। পরে তাঁদের দ্রুত উদ্ধার করে টঙ্গীর শহীদ আহ্‌সান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

হাসপাতালটির জরুরি বিভাগের চিকিৎসক মো. নাফিস প্রথম আলোকে বলেন, হাসপাতালে আনার আগেই ওই মৃত্যু হয়েছে। তাঁদের দুজনেরই মাথায় গুরুতর আঘাত ছিল। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তাঁদের মৃত্যু হয়েছে।

টঙ্গী পূর্ব থানার ওসি মো. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, এ ঘটনায় নিহত ব্যক্তির পরিবার সড়ক পরিবহন আইনে মামলা করেছেন। ইতিমধ্যে ঘটনায় জড়িত বাসটি আটক করে থানায় আনা হয়েছে। বাসের চালক ও সহকারী পলাতক। তাঁদের আটকের চেষ্টা চলছে।