প্রশাসনের হিসাবে ক্ষয়ক্ষতি প্রায় চার কোটি টাকা, সহায়তা মিলেছে সামান্যই

ঘরের সঙ্গে পুড়ে যাওয়া হাঁড়ি-পাতিল খুঁজে বের করছেন ট্রাকচালক আবদুল হাকিম। আজ শনিবার সকালে পঞ্চগড় শহরের উপকণ্ঠে আহম্মদনগর এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

বাড়িঘরে থাকা নগদ টাকা, স্বর্ণালংকারসহ মূল্যবান জিনিসপত্র লুট হয়েছে। কিছু জিনিসপত্র ভাঙচুর করা হয়েছে। আর বাকি আসবাবপত্রসহ ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে পরনের কাপড় থেকে শুরু করে মাথা গোঁজার ঠাঁই পর্যন্ত হারিয়েছেন পঞ্চগড়ের আহমদিয়া সম্প্রদায়ের মানুষেরা। ঘটনার আট দিন পেরিয়ে গেলেও ক্ষয়ক্ষতির তুলনায় এই মানুষেরা সহায়তা পেয়েছেন সামান্যই।

৩ মার্চ আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ‘সালানা জলসা’ বন্ধের দাবিতে করা বিক্ষোভ থেকে পঞ্চগড় শহরের উপকণ্ঠে আহম্মদনগর ও শালশিড়ি এলাকায় দেড় শতাধিক বাড়িঘরে হামলা হয়। আহমদিয়ারা ওই দিন দুপুরে বাড়িঘরে তালা দিয়ে জলসায় ছিলেন। এ সুযোগে বিকেল থেকেই দুষ্কৃতকারীরা প্রথমে তাঁদের বাড়িঘরে হামলা চালান। লুট করে নিয়ে যান সর্বস্ব। পরে বাড়িঘরে আগুন দিয়ে চলে যান। পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না হওয়ায় ঘটনার আট দিন পেরিয়ে গেলেও ঘরে ফিরতে পারছেন না তাঁরা। এমনকি আতঙ্কও কাটেনি তাঁদের।

জেলা প্রশাসনের একটি সূত্রে জানা গেছে, এ ঘটনায় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (সার্বিক) প্রধান করে গঠন করা পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি ক্ষয়ক্ষতির তালিকা তৈরি করেছে। সেই তালিকা অনুযায়ী ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৩ কোটি ৯২ লাখ ৭০ হাজার টাকা। সেই তালিকা ইতিমধ্যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। আহমদিয়ারা চাইলেই তাঁদের পুনর্বাসনসহ সার্বিক সহায়তার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আরও পড়ুন

আহমদিয়াদের হিসাব অনুযায়ী, ১৭৯টি বাড়ি, একটি ওয়াক্তিয়া মসজিদ ও দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। দোকানপাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও হামলা হয়। ক্ষতিগ্রস্ত এসব বাড়িঘরের তালিকা করে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করছেন আহমদিয়া জামাতের নেতারা। তবে সরকারি সহায়তা নিতে চাইলেও কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সহায়তা নিতে চান না তাঁরা।

ঘটনার পর ৬ মার্চ রেলপথমন্ত্রী ও পঞ্চগড়-২ আসনের সংসদ সদস্য নূরুল ইসলাম সুজন ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি ১৭৯টি পরিবারের মাঝে একটি করে শাড়ি, লুঙ্গি, কম্বল এবং ৩০ কেজি করে চাল ও নগদ এক হাজার করে টাকা তুলে দেন। এর মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে কম্বল ও চাল এবং মন্ত্রীর ব্যক্তিগত পক্ষ থেকে শাড়ি-লুঙ্গি ও নগদ টাকা দেওয়া হয়। আহমদিয়া সম্প্রদায়ের নেতারা বলছেন, তাঁরা ত্রাণ নয়; উপহার হিসেবেই এসব গ্রহণ করেছেন।

পোড়া বাড়ির উঠোনে পড়ে আছে পুড়ে যাওয়া বাইসাইকেল। আজ শনিবার সকালে আহম্মদনগরে
ছবি: প্রথম আলো

আজ শনিবার সকাল ১০টার দিকে পঞ্চগড় জেলা শহরের উপকণ্ঠে আহম্মদনগর-ডাঙ্গাপাড়া এলাকায় রংমিস্ত্রি মো. কামরুজ্জামানের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ঘর পুড়ে ছাই হয়েছে। দাঁড়িয়ে আছে সিমেন্টের খুঁটিগুলো। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে পুড়ে যাওয়া আঁকাবাঁকা টিন। উঠানের কোনায় বিবর্ণ হয়ে যাওয়া কাঁঠালগাছটিতে বসে আছে একঝাঁক কবুতর। হাতে একমুঠো শর্ষেদানা নিয়ে শেষ সম্বল কবুতরগুলোকে ডাকছেন কামরুজ্জামান।

কামরুজ্জামান বললেন, আগুনে সব শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু কীভাবে যেন খাঁচায় থাকা ১২টি কবুতরের মধ্যে ১০টি বেঁচে গেছে। বাড়ির সবকিছু শেষ হলেও শখের কবুতরগুলো এখনো ছেড়ে যায়নি। পুড়ে যাওয়া ঘরে শোবার জায়গা না থাকায় আট দিন ধরে মসজিদে থাকছেন তিনি। সেখানেই জামাত থেকে খাওয়ানো হচ্ছে তাঁদের। এই মুহূর্তে নতুন করে বাড়িঘর তৈরির মতো সামর্থ্য নেই তাঁর।

আরও পড়ুন

কামরুজ্জামানের বাড়ি থেকে বের হতেই দেখা নুর ইসলাম আকন্দের (৭২) সঙ্গে। তিনি জানালেন, আগুন দেওয়ার আগে বাড়িঘরের সবকিছুই লুটপাট করা হয়েছে। জামাত থেকে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। এর মধ্যে গত সোমবার রেলমন্ত্রী এসে একটা করে শাড়ি, লুঙ্গি, কম্বল, এক হাজার করে টাকা আর ৩০ কেজি চাল দিয়েছেন। বাড়িতে জায়গা না থাকায় চালগুলো জামাতে জমা রেখেছেন। এর বাইরে আর কোনো সহায়তা পাননি।

আহমদিয়াদের জলসাস্থল থেকে একটি অটোভ্যানে করে কিছু কাপড়চোপড়ের বস্তা নিয়ে বের হচ্ছিলেন সেলিনা বেগম নামের এক নারী। তিনি জানালেন, ঘটনার পর থেকে বেশির ভাগ ক্ষতিগ্রস্ত মানুষই এক কাপড়ে আছেন। এসব কাপড় আহমদিয়া জামাতের পক্ষ থেকে দেওয়া হলো। সেগুলো নিয়ে শালিশিড়ি এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দাদের মাঝে বিতরণ করা হবে।

স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে পুড়ে যাওয়া বাড়িঘরের এক কোনায় বসে ছিলেন ট্রাকচালক আবদুল হাকিম (৪৪)। পুড়ে যাওয়া শোবার ঘরের খাটটি দেখিয়ে তিনি বলছিলেন, ঘরে থাকা দুই ভরি স্বর্ণসহ সংসারের ভালো ভালো যত জিনিসপত্র ছিল, সবকিছুই নিয়ে গেছেন হামলাকারীরা। ঘরের বাইরে বের করে খাট আর ট্রাংকটিতে আগুন দিয়েছে। এমন অবস্থা হয়েছে, পুড়ে যাওয়া এক টুকরা টিনও কাজে লাগানো যাবে না।

আরও পড়ুন

ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা জানান, ঘটনার পর থেকে প্রায় এক কাপড়েই ছিলেন তাঁরা। তবে দুই দিন ধরে আহমদিয়া জামাত থেকে ধীরে ধীরে তাঁদের জন্য কিছু কাপড়ের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আহমদিয়া সম্প্রদায়ের আহম্মদনগর মসজিদ ও শালশিড়ি মসজিদে রান্না করে তাঁদের খাবারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

সামিনা আক্তার (৩৭) নামের এক ভুক্তভোগী বলেন, তাঁর স্বামী নুর আহমেদ নদীতে পাথর তুলে সংসার চালান। আগুন জ্বালানোর আগে ঘরে যা ছিল সব লুটপাট করে নিয়ে গেছে। বাড়িতে থাকার কোনো উপায় নেই। জামেয়া থেকে খাওয়ানো হচ্ছে। তবে একটা করে শাড়ি, লুঙ্গি, কম্বল আর এক হাজার টাকা ও চাল পেয়েছেন তাঁরা।

আহমদিয়া সালানা জলসার আহ্বায়ক আহমদ তবশির চৌধুরী বলেন, আহমদিয়া জামাতের পক্ষ থেকে খাবারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা আহমদিয়া সম্প্রদায়ের লোকজনের পাঠানো কাপড়চোপড় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের মাঝে বিতরণ করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে রেলমন্ত্রীর মাধ্যমে সরকারের দেওয়া কিছু উপহার পেয়েছেন। সরকার যদি ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয়, তাহলে তা গ্রহণ করবেন। তবে ব্যক্তি বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান পর্যায়ের কোনো সহায়তা তাঁরা নিতে চান না।

আরও পড়ুন

পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, আহমদিয়াদের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় জরিপ চালিয়ে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করে একটি তালিকা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সরকারিভাবে তাঁদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সহায়তা করতে জেলা প্রশাসন প্রস্তুত রয়েছে। সেই সঙ্গে আহমদিয়া জামাতের নেতাদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। তাঁরা যেভাবে বলবেন, সেই অনুযায়ী সহায়তার কাজ শুরু হবে।