মহাপরিকল্পনার বাইরে স্থাপনা, এক বছর পরও চালু হয়নি

মহাপরিকল্পনা না মেনে নির্মিত দোকান। বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন শেখ রাসেল মাঠেছবি: প্রথম আলো

মহাপরিকল্পনাকে পাশ কাটিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭৬ লাখ টাকা ব্যয়ে ১৫টি দোকান ও রেস্তোরাঁ নির্মাণ করেছে প্রশাসন। গত বছরের মার্চে স্থাপনাগুলোর নির্মাণকাজ শেষ হলেও এখনো বুঝে নেয়নি কর্তৃপক্ষ। এক বছরের বেশি সময় ধরে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে পৌনে এক কোটি টাকার স্থাপনা। কবে নাগাদ চালু হতে পারে, সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলতে পারছে না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫০ বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। এর তিন বছর পর ২০২২ সালের শেষের দিকে ক্যাম্পাসের পাঁচটি পয়েন্টে ১৫টি দোকান ও রেস্তোরাঁ নির্মাণ শুরু করে প্রশাসন। প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয় ৭৬ লাখ টাকা। তবে এমন কোনো প্রকল্প মহাপরিকল্পনায় উল্লেখ ছিল না। ওই স্থাপনা নির্মাণের কয়েক মাস আগে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গা থেকে অর্ধশতাধিক দোকান উচ্ছেদ করে প্রশাসন। যদিও কয়েক দিন পর আবার যত্রতত্র ভ্রাম্যমাণ দোকান বসতে শুরু করে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের টুকিটাকি চত্বরে দুটি, ডিনস কমপ্লেক্স ভবনের পেছনে লিপু চত্বরে একটি, চারুকলা অনুষদ-সংলগ্ন এলাকায় দুটি, মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পাশে ও শেখ রাসেল মাঠের দক্ষিণ পাশে পাঁচটি করে মোট ১৫টি দোকান নির্মাণ করা হয়েছে। স্থাপনাগুলো সেমি পাকা টিনশেডের।

মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন কমিটির সদস্য ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন দপ্তরের পরিচালক খন্দকার শাহরিয়ার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মহাপরিকল্পনায় ক্যাম্পাসের কোথাও বিচ্ছিন্ন দোকান নির্মাণের উল্লেখ নেই। যে দোকানগুলো হয়েছে, সেগুলো অস্থায়ী। মহাপরিকল্পনায় একটি ১০ তলা কমপ্লেক্স নির্মাণের কথা বলা হয়েছে। যেখানে যাবতীয় দোকান থাকার কথা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী (ভারপ্রাপ্ত) মো. আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষার্থীদের সুস্বাস্থ্য ও ক্যাম্পাসের পরিবেশ সুন্দর করতে অস্থায়ীভাবে দোকানগুলো নির্মাণ করা হয়েছে। মহাপরিকল্পনা দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। ধীরে ধীরে তা বাস্তবায়ন করা হবে।

বরাদ্দ পাবেন কারা

দোকান ও রেস্তোরাঁর দায়িত্ব কাদের দেওয়া হবে কিংবা কোন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বরাদ্দ দেওয়া হবে, এ নিয়ে ক্যাম্পাসের ভ্রাম্যমাণ দোকানিদের মধ্যে চলছে নানা আলোচনা। এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি প্রশাসন। কয়েক মাস আগে এ ব্যাপারে একটি সভা হয়। সভায় বরাদ্দ নিয়ে আলোচনা হলেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। সেখানে ভাড়া ও জামানত নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

প্রধান প্রকৌশলী (ভারপ্রাপ্ত) আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, ক্যাম্পাসে ভ্রাম্যমাণ অনেক দোকানি আছেন। তাঁদের মধ্য থেকে বাছাই করলে ঝামেলা হতে পারে। স্বচ্ছতার জন্য দরপত্রের মাধ্যমে সর্বোচ্চ দরদাতাদের মধ্যে দোকান ও রেস্তোরাঁ বরাদ্দ দেওয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন।

দোকান-রেস্তোরাঁ বরাদ্দ দেওয়ার জন্য গঠিত কমিটির প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. ওবায়দুর রহমান প্রামাণিক বলেন, কাদের বরাদ্দ দেওয়া হবে, এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। দোকান বুঝে পাওয়ার পর এ সিদ্ধান্ত নেবে প্রশাসন। এখন ভাড়া ও জামানত ঠিক করা হয়েছে। শিগগিরই চালু হতে পারে।

ছাত্রলীগ ও প্রভাবশালীদের তদবির

দোকান ও রেস্তোরাঁ বরাদ্দ পেতে ক্যাম্পাসের ভ্রাম্যমাণ অনেক দোকানি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের অনেক নেতা ও প্রভাবশালী শিক্ষকদের কাছে জোর তদবির চালাচ্ছেন বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। ক্যাম্পাসের প্রভাবশালী কয়েকজন শিক্ষক বিষয়টি দেখবেন বলেও দোকানিদের আশ্বাস দিয়েছেন। তবে দরপত্র ছাড়া দোকান বরাদ্দ দিলে সমস্যা তৈরি হতে পারে বলে কেউ কেউ আশঙ্কা করেছেন। প্রশাসনের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা অবশ্য তদবিরের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন দোকানি প্রথম আলোকে বলেন, দোকান বরাদ্দ পেতে ক্যাম্পাসের অনেক দোকানি চেষ্টা-তদবির করছেন। তাঁরাও বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক ও ছাত্রলীগ নেতার সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলেছেন। তাঁরাও বিষয়টি দেখবেন বলে জানিয়েছেন। তবে তাঁরা ছাত্রলীগের নেতা বা ওই শিক্ষকদের নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।

এর আগে গত বছরের জানুয়ারিতে নির্মাণাধীন দুটি দোকান ভাঙচুর করেছিল দুর্বৃত্তরা। অভিযোগ উঠেছিল, ঠিকাদারের কাছে চাঁদা না পেয়ে ছাত্রলীগের দুজন নেতা এ ঘটনা ঘটান। তবে এ ব্যাপারে ঠিকাদার কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

আরও পড়ুন

দাম-মান নজরদারি করবে প্রশাসন

ক্যাম্পাসের ভ্রাম্যমাণ দোকানগুলোতে অনেক শিক্ষার্থী সকাল ও দুপুরের খাবার খান। এসব দোকানে শিক্ষার্থীদের অস্বাস্থ্যকর খাবার পরিবেশন ও অতিরিক্ত মূল্য আদায়ের অভিযোগ আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাকেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৫ জানুয়ারি থেকে ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ২১ দিনে ১৩১ জন শিক্ষার্থীর শরীরে জন্ডিস শনাক্ত হয়েছিল। এ থেকে উত্তরণে নতুন দোকানগুলোর খাবারের মান ও দাম নিশ্চিত করতে নিয়মিত নজরদারি করবে প্রশাসন। প্রশাসনের একাধিক কর্তাব্যক্তি বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

দোকানগুলো আগেই চালু হওয়া উচিত ছিল বলে মনে করেন সহ–উপাচার্য সুলতান-উল-ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ক্যাম্পাসের খাবারের দোকানগুলো এলোমেলোভাবে আছে। একদিকে শিক্ষার্থীরা স্বাস্থ্যকর খাবার পাচ্ছে না, অন্যদিকে ক্যাম্পাসের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের কথা ভেবে দোকান নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। অনেক আগে নির্মাণকাজ শেষ হলেও এখনো চালু হয়নি। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। শিগগিরই চালু হবে।

আরও পড়ুন