পদ্মা সেতুর এক্সপ্রেসওয়েতে যে কারণে বাগে আনা যাচ্ছে না বাসের বিপজ্জনক গতি

স্পিডগান নিয়ে গাড়ির গতি পরীক্ষা করছেন মাদারীপুর হাইওয়ে পুলিশের এক সদস্য
ছবি: প্রথম আলো

পদ্মা সেতুর এক্সপ্রেসওয়েতে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়মিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর বেশির ভাগ দুর্ঘটনা বাসের বিপজ্জনক গতির কারণে ঘটছে বলে মাদারীপুর হাইওয়ে পুলিশের ভাষ্য। যদিও এ মহাসড়কে চলাচলকারী গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে স্পিডগান। দ্রুতগতিতে চলাচলকারী গাড়ির বিরুদ্ধে প্রতিদিন মামলা দিয়ে আদায় করা হচ্ছে জরিমানাও। তবু গাড়িগুলোর বিপজ্জনক গতি নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। নিয়মিত ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা।

হাইওয়ে পুলিশের মাদারীপুর অঞ্চল সূত্র জানায়, পদ্মা সেতু উদ্বোধন হয় ২০২২ সালের ২৫ জুন। তখন থেকে চলতি বছরের ১৯ মার্চ পর্যন্ত ২২২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৬৪ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনাটি ঘটে গত রোববার মাদারীপুরের শিবচরে পদ্মা সেতুর এক্সপ্রেসওয়েতে। ওই দিন ইমাদ পরিবহনের একটি বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নিচে পড়ে দুমড়েমুচড়ে যায়। এতে ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে।

হাইওয়ে পুলিশের মাদারীপুর রিজিওন থানা রয়েছে আটটি। হাইওয়ে পুলিশ সূত্র বলছে, ইমাদ পরিবহনের বাসটি বিপজ্জনক গতির কারণে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। ওই সড়কে সর্বোচ্চ গতিসীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছিল ৮০ কিলোমিটার। কিন্তু বাসটি চলছিল এর চেয়ে অনেক বেশি গতিতে। বাসটি একসময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটি মাইলফলক ও পাঁচটি গাছ ভেঙে ৫০ ফুট নিচে পড়ে যায়।

এক্সপ্রেসওয়েতে ভয়াবহ ওই দুর্ঘটনার পঞ্চম দিনে গত বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত ১২টি পরিবহনকে গতিসীমা অতিক্রম করার অভিযোগে মামলা দিয়েছে শিবচর হাইওয়ে পুলিশ। এর মধ্যে বেপরোয়া গতির কারণে ইমাদ পরিবহনের একটি বাসকেও জরিমানা করা হয়।

দ্রুতগতিতে বাস চালানোর বিষয়ে মালিকপক্ষের কোনো নির্দেশনা আছে কি না, জানতে চাইলে ফরিদপুর গোল্ডেন লাইন পরিবহনের ব্যবস্থাপক রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের পক্ষ থেকে দ্রুতগতিতে গাড়ি চালানোর কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয় না। তবে সড়কে প্রতিযোগিতা করে গাড়ি চালানোর মানসিকতা রয়েছে অনেক চালকের। এ ছাড়া আস্তে চালালে যাত্রীরা অনেক সময় চিৎকার-চেঁচামেচি করেন, যে কারণে চালক দ্রুতগতিতে গাড়ি চালান।’

সড়কে গতি নিয়ন্ত্রণ করা গেলে দুর্ঘটনার হার কমে আসবে বলে মনে করেন ফরিদপুর বাস মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক মো. আনিসুর রহমান। তিনি বলেন, ‘গতিনিয়ন্ত্রণের জন্য চালকের সতর্কতা জরুরি। পাশাপাশি একনাগাড়ে গাড়ি চালানোয় ও বিশ্রাম না পাওয়ায় চালকের ঘুম ঘুম ভাব এবং মুঠোফোনে কথা বলা সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। এ ছাড়া শ্রমিকদের ওপরও সব সময় নিয়ন্ত্রণ রাখা যায় না, আমাদের অনেক সমঝোতা করতে হয়।’

নিয়মিত দ্রুতগতির বাসের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে জরিমানা আদায় করা হয় বলে জানিয়েছে হাইওয়ে
ছবি: প্রথম আলো

পদ্মা সেতু হয়ে ফরিদপুর থেকে ঢাকায় নিয়মিত যাতায়াত করেন শহরের ভাটি লক্ষ্মীপুর মহল্লার বাসিন্দা মুমিনুল হক। তিনি বলেন, সবাই গতির সঙ্গে থাকতে চায়, কেউ পিছিয়ে পড়তে চায় না। কোনো গাড়ি ওভারটেক করলে যাত্রীরা খুশি হন, আবার দ্রুতগতিতে চাললে তাঁরা খেপে যান। সব মিলিয়ে একটি ভজকট অবস্থার সৃষ্টি হয়, যে কারণে দুর্ঘটনা বাড়ছে।

গত বছরের ডিসেম্বর থেকে ১৯ মার্চ পর্যন্ত মাদারীপুর অঞ্চলের আটটি হাইওয়ে থানায় অতিরিক্ত গতি, দুর্ঘটনাসহ বিভিন্ন অভিযোগে মোট ৮ হাজার ৯২টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ৩ হাজার ৪৫২টি মামলা হয়েছে দ্রুতগতির কারণে, যা মোট মামলার ৪৩ শতাংশ।

এর মধ্যে কতগুলো বাসের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তা জানাতে পারেনি হাইওয়ে পুলিশ। এ অঞ্চলের হাইওয়ে পুলিশ সুপার মো. মাহবুবুল আলম বলেন, ‘এর বেশির ভাগ মামলা বাস, ব্যক্তিগত গাড়ি ও মাইক্রোবাসের বিরুদ্ধে। এই এক্সপ্রেসওয়েতে সাধারণত ৯০ কিলোমিটারের মধ্যে থাকলে আমরা ওই বাসকে জরিমানা করি না। কিন্তু বাসগুলোর গড় গতি পাওয়া যায় ১১৫ কিলোমিটার। কোনো কোনো বাস ১৩০ কিলোমিটার গতিতেও চলে।’

আরও পড়ুন

তবে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জুবায়ের জাকিরের ভাষ্য ভিন্ন। তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘পদ্মা সেতু হওয়ার পর দক্ষিণের ২১টি জেলায় যে সংখ্যক গাড়ি চলাচল করছে, এর ৯৫ শতাংশের কোনো রুট পারমিট নেই। এসব গাড়ি সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে  ম্যানেজ করে অবৈধভাবে চলছে। কোনো গাড়ি যখন দুর্ঘটনায় পড়ে, তখন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) বা হাইওয়ে পুলিশ নিজেদের দোষ ঢাকার জন্য দ্রুতগতির কথা বলে দায় আমাদের ওপর চাপানোর চেষ্টা করে। কিন্তু গাড়িটির ফিটনেস আছে কি না বা দ্রুতগতিতে চলছে কি না, তা দেখার দায়িত্ব ওই দুই প্রতিষ্ঠানের। পাশাপাশি এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, আমাদের কিছু কিছু চালক বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালান।’

এই পথে চলাচলকারী একটি বাসের চালক হেলাল ফকিরের ভাষ্য, যাত্রীদের তাড়া এবং মালিকপক্ষের চাহিদার কারণে চালকেরা দ্রুতগতিতে গাড়ি চালান। অনেক মালিক আছেন তাঁরা মনে করেন, দ্রুতগতিতে আগে গন্তব্যে পৌঁছে দিতে পারলে তাঁদের সুনাম বাড়বে এবং যাত্রী বেশি পাওয়া যাবে।

দ্রুতগতি ও চালকের অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস দুর্ঘটনার একটি বড় কারণ বলে মনে করেন ফরিদপুর জেলা বিআরটিএর সহকারী পরিচালক এমরান খান।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

তবে তিনি বলেন, ‘সড়কের বাঁক ও ত্রুটির কারণেও দুর্ঘটনা ঘটছে। ফিটনেসবিহীন গাড়ির তালিকা করে আমরা জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে জমা দিই। মাঠে থাকে পুলিশ। এ ব্যাপারে তাদের ভূমিকা বেশি।’ ঝুঁকিপূর্ণ বাঁকের বিষয়ে ফরিদপুর সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ইমরান ফারহান বলেন, মহাসড়কে যে বাঁকগুলো রয়েছে, তা চিহ্নিত করে ঠিক করা হচ্ছে।

হাইওয়ে পুলিশ সুপারের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, হাইওয়ে মাদারীপুর রিজিওনের আওতাধীন এলাকার দৈর্ঘ্য ৩৮১ কিলোমিটার। এর মধ্যে মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জ জেলারও কিছু অংশ রয়েছে। আটটি হাইওয়ে থানার মাধ্যমে এ কার্যক্রম চালানো হয়। প্রতিটি থানায় দুটি করে স্পিডগান রয়েছে, যা দিয়ে গতি পরিমাপ করা হয়। থানায় অপর্যাপ্ত জনবলের কারণে ২৪ ঘণ্টা গতিনিয়ন্ত্রণে কাজ করা সম্ভব হয় না।

ফরিদপুর নাগরিক মঞ্চের সভাপতি আওলাদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, লাইসেন্সবিহীন অদক্ষ চালক, ফিটনেসবিহীন ও অবৈধ গাড়ির কারণে দুর্ঘটনা বাড়ছে। পরিবহনমালিকেরা লাইসেন্সবিহীন চালকদের বেশি পছন্দ করেন। কারণ, তাঁদের বেতন কম দিতে হয়। পাশাপাশি ৮ ঘণ্টার জায়গায় দিনে ১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত গাড়ি চালাতে বাধ্য করা হয়। এ ক্ষেত্রে বিআরটিএ ও পুলিশের নজরদারি ও সততা জরুরি। সিসি ক্যামেরা স্থাপন করে নজরদারি ও তাৎক্ষণিকভাবে জরিমানা করতে হবে। সেটা না করা গেলেও পরে জরিমানার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।

আরও পড়ুন