মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা
গয়না বিক্রি করে ও ৭০ হাজার টাকা বাকিতে একমাত্র ছেলেকে মোটরসাইকেল কিনে দিয়েছিলেন তাঁরা
‘কয়েক মাস আগে পাশের গ্রামে বাইক অ্যাক্সিডেন্টে একটি ছেলে মারা যায়। এর পর থেকেই আমি আতঙ্কে থাকতাম। ছেলের বায়না শুনে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করি। পরিকল্পনা ছিল এসএসসি পাস করলে কোনো ব্যবসায় যুক্ত করব। তারপর বাইক কিনে দেব। কিন্তু তাকে রাজি করাতে পারিনি। দুবার আত্মহত্যার চেষ্টা করে। গাড়ির নিচে মাথা দিতে চায়। বাধ্য হয়ে ধারদেনা করে বাইক কিনে দিই। ছেলের জিদে আমার সব শেষ হয়ে গেল।’
আক্ষেপ করে কথাগুলো বলছিলেন রাজবাড়ীর সদর উপজেলার দাদশী ইউনিয়নের গোপীনাথদিয়া গ্রামের লাল মিয়া শেখ। গতকাল মঙ্গলবার সকালে মোটরসাইকেলের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তাঁর ছেলে রাজনসহ দুজন নিহত হয়। অন্যজন রাজনের বন্ধু পাশের আলীপুর ইউনিয়নের ইন্দ্রনারায়ণপুর গ্রামের রব প্রামাণিকের ছেলে সোহাগ প্রামাণিক (১৬)। সে শহরের শ্রীপুর বাজারে একটি মোটর গ্যারেজে কাজ করত। রাজন আলাদীপুর উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণিতে পড়ত।
লাল মিয়া শেখ প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাজন একটি কোচিংয়ে ক্লাস করত। সেখানে অনেক ছেলে বাইক নিয়ে আসে। কয়েক দিন আগে এক বন্ধুর বাইকে বসে রাজন ছবি তোলে। তখন ওই বন্ধু তাকে বলেছিল, “বাপের এক ছেলে, নিজে মোটরসাইকেল কিনতে পারিস না? অন্যের মোটরসাইকেলে বসে ছবি তুলিস।” ওই ঘটনার পর রাজনের একমাত্র ধ্যানজ্ঞান হয়ে ওঠে মোটরসাইকেল কেনা।’
বুধবার সকালে রাজনদের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, রাজনের মা ছেলের শোকে প্রলাপ বকছেন। স্বজনেরা তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। বাবা লাল মিয়া বাক্রুদ্ধ অবস্থায় বারান্দায় বসে আছেন। কারও সঙ্গে তেমন একটা কথা বলছেন না।
রাজনের মা শিরিন বেগম বলেন, রাজন পড়ালেখার পাশাপাশি রাজমিস্ত্রির সহকারী (জোগালি) কাজ করত। পাশের বাড়িতে কাজ করার কথা ছিল। এ জন্য খুব সকালে মোটরসাইকেল নিয়ে বের হয়। বাড়ি এসে খেয়ে কাজে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাড়ি থেকে বের হওয়ার আধা ঘণ্টার মধ্যে সে অ্যাক্সিডেন্ট করে। তিনি বলেন, ‘আমার আর কোনো সন্তান নেই। ছেলের ইচ্ছা পূরণ করার চেষ্টা করতাম। কয়েক দিন ধরে মোটরসাইকেল কিনে নিতে উঠেপড়ে লাগে। বাড়িতে ভাঙচুর করতে থাকে। আত্মহত্যার চেষ্টা করে। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যায়। মোটরসাইকেল কিনে না দিলে রাস্তায় গাড়ির নিচে মাথা দেওয়ার হুমকি দেয়। উপায় না দেখে গরু বিক্রি, ধারদেনা করে এক লাখ টাকা জোগাড় করি।’
শিরিন বেগম বলেন, ‘রাজন ২ লাখ ৮০ হাজার টাকার মোটরসাইকেল পচ্ছন্দ করে। অনেক বুঝিয়ে ২ লাখ ৪০ হাজার টাকার মোটরসাইকেল নিতে রাজি করাই। কিন্তু ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা বাকি রেখে মোটরসাইকেল বিক্রি করতে রাজি হয়নি শোরুম কর্তৃপক্ষ। তখন রাজন আবার গাড়ির নিচে মাথা দেওয়ার চেষ্টা করে। বাধ্য হয়ে হাতের বালা বিক্রি করি। এরপর ৭০ হাজার টাকা বাকিতে মোটরসাইকেল নেওয়া হয়। টাকা পরিশোধের আগেই ছেলে চলে গেল।’
প্রতিবেশী খালেক শিকদার বলেন, এলাকার উঠতি বয়সী অনেক ছেলের মোটরসাইকেল আছে। অনেকের বাবা গরিব। তাঁকেও মোটরসাইকেল কিনে দিতে বাধ্য করেছে। কয়েক দিন আগে আরেক ছেলে মোটরসাইকেল কিনে না দেওয়ায় একতলা বাড়ির ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। রাজনও একই কাজ করেছিল। বাধ্য হয়ে তার মা–বাবা মোটরসাইকেল কিনে দেন।
স্থানীয় সূত্র জানায়, রাজন অনেক আগে থেকেই মোটরসাইকেল কেনার বায়না ধরে। বয়স কম হওয়ায় মা–বাবা পাত্তা দেননি। ঘুমের বড়ি খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। এরপর কিছুদিন স্বাভাবিক ছিল। সপ্তাহখানেক আগে আবার আত্মহত্যার হুমকি দেয়। এরপরও মা-বাবা রাজি হননি। গত শুক্রবার সকালে বাড়িতে আত্মহত্যার চেষ্টা করে রাজন। ঘরের দরজা ভেঙে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা তাকে উদ্ধার হাসপাতালে নিয়ে যান। চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরলে শনিবার ধারদেনা করে মোটরসাইকেল কিনে দেয় পরিবার। সেই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মঙ্গলবার সে নিহত হয়।