কক্সবাজার শহরের উপকূলের লোকজন ছুটছেন নিরাপদ আশ্রয়ে

ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ আতঙ্কে কক্সবাজার শহরের নাজিরারটেক এলাকার অনেকেই ঘরবাড়ির ছেড়ে হোটেলে আশ্রয় নিয়েছেন। শনিবার বিকেলে
ছবি: প্রথম আলো

ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’র প্রভাবে আজ শনিবার বিকেলে কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরে ১০ নম্বর মহাবিপৎসংকেত ঘোষণার পর থেকে কক্সবাজার শহরের উপকূলীয় এলাকার লোকজন ঘরবাড়ি ফেলে নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটছেন।

জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে স্থানীয় ব্যক্তিদের আশ্রয়ের জন্য ৬০টির বেশি বহুতল হোটেল, ১০টির বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি ভবন খুলে দেওয়া হয়েছে। আজ বিকেল চারটা পর্যন্ত নাজিরারটেক থেকে অন্তত পাঁচ হাজার মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়েছেন। আরও পাঁচ-ছয় হাজার মানুষ উপকূল ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

কক্সবাজার পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের নাজিরারটেক, কুতুবদিয়াপাড়া, সমিতিপাড়া, মোস্তাইক্যাপাড়া, বাসিন্যাপাড়া, ফদনারডেইলসহ ১৮টি গ্রামে অন্তত ৪৫ হাজার মানুষের বাস। তাঁদের ৯০ শতাংশ শ্রমজীবী, যাঁরা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কাজের সন্ধানে এসেছেন। ঝড়–জলোচ্ছ্বাসে এসব এলাকা প্লাবিত হয়। গত বছরের অক্টোবরের ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের সময় জলোচ্ছ্বাসে কয়েক শ ঘরবাড়ি বিলীন হয়েছিল।

জেলা প্রশাসনের পর্যটন শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাসুম বিল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, সৈকত এলাকার ৬৮টি হোটেল ও গেস্টহাউস উপকূলীয় এলাকা থেকে আসা লোকজনের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। এসব হোটেলে কমপক্ষে সাত-আট হাজার লোক থাকা যাবে। স্থান সংকুলান না হলে আরও হোটেল খুলে দেওয়া হবে।

আরও পড়ুন

ঘূর্ণিঝড় মোখা মোকাবিলায় সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, উপকূলের ছয় লাখ মানুষকে সরিয়ে আনতে জেলার নয়টি উপজেলাতে ৫৭৬টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র খুলে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া সেন্টমার্টিন ও কক্সবাজার শহরে শতাধিক হোটেল গেস্টহাউসের পাশাপাশি কয়েকশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি ভবন প্রস্তুত রাখার হয়েছে। দুর্যোগ মোকাবিলায় মাঠে নেমেছে ১০ হাজার স্বেচ্ছাসেবী। জেলার সব সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তাদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। জেলা প্রশাসন কার্যালয়সহ ৯টি উপজেলায় খোলা হয়েছে পৃথক ১০টি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ।

শনিবার বিকেলে শহরের সমিতি পাড়ায় গিয়ে দেখা গেছে, লোকজন ঘরের প্রয়োজনীয় মালামাল সঙ্গে নিয়ে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক (টমটম), রিকশা, বাস ও অটোরিকশায় করে শহরের দিকে যাচ্ছেন। কেউ কেউ সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছেন গৃহপালিত হাঁসমুরগি, গরু–ছাগলসহ প্রয়োজনীয় মালামাল।

সাজেদা আকতার (৪৫) নামের একজন নারী তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁর মাথায় ছিল কাপড়ের ব্যাগ। কোথায় যাচ্ছেন জানতে চাইলে সাজেদা প্রথম আলোকে বলেন, শহরের একটি গেস্টহাউসে তাঁদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। তাঁর সঙ্গে সমিতি পাড়ার আরও কয়েকটি পরিবার সেখানে যাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড়ের বিপদ কেটে না যাওয়া পর্যন্ত তাঁরা হোটেলে থাকবেন।

নাজিরারটেক এলাকার অনেক পরিবার ঘরবাড়ি ছাড়ার সময় সঙ্গে নিয়েছেন গবাদিপশুও। শনিবার বিকেলে কক্সবাজার শহরের পৌর প্রিপারেটরি উচ্চবিদ্যালয় ভবনে
ছবি: প্রথম আলো

পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আকতার কামাল প্রথম আলোকে বলেন, সিত্রাংয়ের তুলনায় ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’র আঘাতে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে—এমন আশঙ্কায় উপকূলের লোকজন আগেভাগে ঘরবাড়ি ছেড়ে শহরের দিকে ছুটছেন। শ্রমজীবীদের জন্য জেলা প্রশাসন ৫০-৬০টি হোটেল খালি রেখেছে। এখন লোকজন সেদিকে ছুটছে। বিকেল চারটা পর্যন্ত অন্তত পাঁচ হাজার মানুষ এলাকা ছেড়েছে। সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ আরও পাঁচ–ছয় হাজার মানুষ এলাকা ছাড়তে পারেন।

নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে এলাকায় মাইকিং করা হচ্ছে জানিয়ে আকতার কামাল বলেন, বেলা দুইটার পর থেকে সাগরে ভাটা চলছে। রাত ১০টার দিকে সাগরে আবার জোয়ার শুরু হবে। ঘূর্ণিঝড়ের অবস্থা দেখে তখন আরও মানুষ ঘরবাড়ি ছাড়তে পারে।

বিকেলে শহরের হোটেল–মোটেল জোনে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে উপকূল থেকে ছুটে আসা লোকজনের রাত যাপনের জন্য গেস্টহাউসে কক্ষ বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। সড়কের পূর্বপাশে লাগোয়া ডায়মন্ড প্লেস গেস্টহাউসে উঠেছে শতাধিক মানুষ। হোটেল ওয়েল পার্ক, রিগ্যাল প্যালেস, বিচ হলিডে, হোটেল প্রাইম পার্ক, হোটেল অস্টারিকাতেও কয়েকশ লোক আশ্রয় নিয়েছে।

কক্সবাজার হোটেল–গেস্টহাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম সিকদার প্রথম আলোকে বলেন, শনিবার বিকেল চারটা পর্যন্ত ১০-১২টি হোটেল ও গেস্টহাউসে ছয় শতাধিক মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। রাত ১০টার আগে আরও কয়েক হাজার আসতে পারে। ৬০ টির বেশি কটেজ-গেস্টহাউসে অন্তত সাত হাজার মানুষ থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের বুলেটিনে বলা হয়েছে, অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ কক্সবাজার উপকূলের দিকে ধেয়ে আসছে। শনিবার সন্ধ্যায় কক্সবাজার, টেকনাফ ও সেন্টমার্টিনের কাছাকাছি উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড়ের অগ্রভাগের প্রভাব পড়তে পারে।

আগামীকাল রোববার সকাল ছয়টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যে ঘূর্ণিঝড়টি কক্সবাজার ও উত্তর মিয়ানমার উপকূল অতিক্রম করতে পারে। এ সময় স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৮ থেকে ১২ ফুট বেশি উচ্চতার বাযুতাড়িত জলোচ্ছ্বাসে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হতে পারে।