‘খামারিদের ৩০-৫০ পয়সা বাড়িয়ে দিয়ে তাঁরা দুই-আড়াই টাকা হাতিয়ে নেন’

মুরগির ডিম সংগ্রহ করছেন মোস্তফা মোল্লা। গতকাল দুপুরে নরসিংদীর শিবপুরের জয়নগর ইউনিয়নের গিলাবের গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

নরসিংদীর শিবপুরের গিলাবের গ্রামে মোস্তফা মোল্লার পাঁচ হাজার লেয়ার মুরগির খামার রয়েছে। বাজারে ডিমের দাম বাড়লেও খামারিরা খুব একটা লাভবান হন না বলে দাবি তাঁর। তিনি বলেন, ‘ঢাকার ব্যবসায়ীরা ফোন করে আড়তদারদের যে দাম ধরে দেন, ওই দামেই তাঁদের ডিম বিক্রি করতে হয়। গত কিছুদিন খামারিরা ভালো দাম পেলেও এর চেয়ে অনেক বেশি দামে বাজারে ডিম বিক্রি হচ্ছে। এর পেছনে নিশ্চয় বড় কোনো সিন্ডিকেট কাজ করছে। খামারিদের ৩০-৫০ পয়সা বাড়িয়ে দিয়ে তাঁরা দুই-আড়াই টাকা হাতিয়ে নেন।’

নরসিংদী জেলাকে বলা হয়ে থাকে ‘ডিম উৎপাদনের হাব’। জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী, জেলায় মোট ২ হাজার ৩২১টি লেয়ার মুরগির খামার রয়েছে, যেখানে বছরে প্রায় চার কোটি ডিম উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে স্থানীয় চাহিদা রয়েছে প্রায় সোয়া দুই কোটি ডিম। বাকি ডিম ছড়িয়ে পড়ে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায়। সবচেয়ে বেশি ডিমের উৎপাদন হয় জেলার বেলাব ও শিবপুরে।

গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে শিবপুরের জয়নগর ইউনিয়নের গিলাবের গ্রামের খামারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, লেয়ার মুরগির খামারে একটি ডিম উৎপাদনে খরচ হচ্ছে প্রায় ১০ টাকা ৫০ পয়সা। আড়তদার এই ডিম সংগ্রহ করছেন ১১ টাকায়। প্রতি ডিমে ১৫ পয়সা লাভে আড়তদার তা বিক্রি করছেন স্থানীয় বা রাজধানীর ব্যবসায়ীদের কাছে।

খামারি কিন্তু ডিমের দাম বেশি পাচ্ছেন না। অতিরিক্ত লাভের আশায় একদল মধ্যস্বত্বভোগী ডিমের দাম বাড়িয়ে দিয়ে বাজার অস্থিতিশীল করে তুলেছে।
জুনাইদ ইবনে হামিদ, অতিরিক্ত জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা, নরসিংদী

একই দিন বিকেল চারটার দিকে নরসিংদী শহরের প্রধান বাজারে একটি ডিম পাইকারি বিক্রি হচ্ছিল ১৩ টাকা ৭৫ পয়সায়। মুদি দোকানে খুচরায় যা বিক্রি হচ্ছে ১৫ টাকায়। মাত্র দুটি হাত বদল হওয়ার পরই প্রতিটি ডিমের দাম বেড়ে গেছে ৩ টাকা ৮৫ পয়সা। খামারিরা বলছেন, এই হাতবদলে খরচ হওয়ার কথা সর্বোচ্চ ৫০ পয়সা।

সরেজমিনে ঘুরে সংশ্লিষ্ট লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ডিমের দাম কত করে ধরা হবে, তার নিয়ন্ত্রণ খামারিদের কাছে নেই। স্থানীয় আড়তদারেরা চার দিন পরপর এসে খামারে উৎপাদিত ডিম নিয়ে যান। ঢাকার বাজারে ডিমের দাম নির্ধারণ হওয়ার আগেই আড়তদারেরা ঢাকার ব্যবসায়ীদের পাঠানো গাড়িতে ডিম তুলে দেন। পরে ব্যবসায়ীরা ফোন করে ডিমের দর জানিয়ে দেন। পরদিন সকালে ডিমের দাম পান খামারিরা।

আরও পড়ুন

কয়েক খামারি বলেন, সম্প্রতি কয়েক দফা ফ্লুর কারণে প্রচুর মুরগি মারা গেছে। এ ছাড়া রোজা ও কোরবানির ঈদের সময় ডিমের চাহিদা একটু কম থাকে। এই চার মাস প্রায় সব কৃষকই খামারের বেশ কিছু মুরগি বিক্রি করে থাকেন। এর ফলে চাহিদার তুলনায় বর্তমানে ডিমের উৎপাদন কিছুটা কম। এ কারণে বাজারে ডিমের দাম বেড়েছে। ক্ষতি পোষাতে একটু ভালো দাম পাওয়া খুবই প্রয়োজন ছিল তাঁদের। কিন্তু খামার থেকে ১১ টাকার কাছাকাছি বিক্রি করা ডিম কয়েক হাত ঘুরে ভোক্তাদের হাতে পৌঁছাতেই ১৫-১৬ টাকা হয়ে যাওয়া বিস্ময়কর।

১৫ বছর ধরে লেয়ার মুরগি পালন করেন শিবপুরের গিলাবের গ্রামের মো. মামুন মিয়া। আগে খামারে ৬ হাজার মুরগি থাকলেও বর্তমানে আছে সাড়ে ৩ হাজার। বাকিগুলো ফ্লুতে মারা গেছে। মামুন মিয়া জানান, সাধারণত নতুন মুরগি হলে ৯৫ শতাংশ ডিম পাওয়া যায়। বয়স হয়ে গেলে ৮০ শতাংশে দাঁড়ায়। বর্তমানে প্রতিদিন আড়াই হাজারের বেশি ডিম খামার থেকে সংগ্রহ করছেন।

জানুয়ারি থেকে মুরগির খাবার-ওষুধ খরচ ও শ্রমিকদের মজুরি অত্যধিক বেড়েছে উল্লেখ করে মামুন মিয়া বলেন, ‘এখন প্রতিটি ডিমের উৎপাদন খরচ প্রায় সাড়ে ১০ টাকায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। গত কয়েক দিন বাজারে ডিমের দাম ভালো পেয়েছি, তিন দিন আগে ১১ টাকা ৫৫ পয়সা হয়েছিল। তবে গতকাল (বুধবার) থেকে ডিমের দাম আবার কমতে শুরু করেছে। আজ ১১ টাকা দাম ধরা হয়েছে। অথচ শুনতে পাই, ডিমের দাম ১৫-১৬ টাকা হয়েছে। কিন্তু আমরা তো ওই অনুযায়ী দাম পাচ্ছি না। কারা এভাবে দাম বাড়িয়েছে, সেটাও জানি না।’

আরও পড়ুন

পার্শ্ববর্তী গাবতলী এলাকার আড়তদার মিজান মিয়া বলেন, খামার থেকে ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছাতে অন্তত চারটি ধাপ পার হতে হয় প্রতিটি ডিমকে। ডিমপ্রতি সর্বোচ্চ ১৫ পয়সা লাভ দিয়ে রাজধানীর কারওয়ান বাজার বা কাপ্তান বাজারের ব্যবসায়ীরা আড়ত থেকে ডিম নিয়ে যান। ব্যবসায়ী ও ডিলাররা ডিমপ্রতি ১০ পয়সা লাভ নিয়ে দোকানে দোকানে ছড়িয়ে দেন। গাড়িভাড়া ও ক্যারিং খরচ ধরা হয় আরও ২৫ পয়সা। ওই অনুযায়ী বাজারে ডিমের দাম হওয়া উচিত সর্বোচ্চ ১২ টাকা।

নরসিংদীর বটতলা বাজারের পাইকারি ডিম বিক্রেতা রিপন মিয়া গতকাল ১৩ টাকা দরে ডিম বিক্রি করেছেন। ডিম কেনার একটি রিসিট দেখিয়ে তিনি বলেন, ১২ টাকা ৬০ পয়সা তাঁর কেনা দাম। ক্যারিংয়ের সময় অনেক ডিম ভেঙে যায়, নষ্ট হয়। তার জন্য ১৩ টাকার কমে তিনি বিক্রি করতে পারছেন না। অন্যদিকে শহরের কয়েকটি মুদিদোকান ঘুরে ১৫ টাকা করে ডিম বিক্রি করতে দেখা গেছে।

আরও পড়ুন

নরসিংদীর অতিরিক্ত জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা জুনাইদ ইবনে হামিদ বলেন, ‘আমরা হিসাব করে দেখেছি, বর্তমানে একটি ডিমের উৎপাদন খরচ পড়ে সাড়ে ১০ টাকা। খামারিরা দাম পাচ্ছেন ১১ টাকার কাছাকাছি। আর বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১৫-১৬ টাকায়। ওই হিসাবে খামারি কিন্তু ডিমের দাম বেশি পাচ্ছেন না। অতিরিক্ত লাভের আশায় একদল মধ্যস্বত্বভোগী ডিমের দাম বাড়িয়ে দিয়ে বাজার অস্থিতিশীল করে তুলেছে।’

আরও পড়ুন