পায়রা সেতুর টোল প্লাজায় জরিমানা ফাঁকি দিতে ছোট সড়কে অতিরিক্ত পণ্যবাহী ট্রাক

পায়রা সেতুতে ওয়ে স্কেল বসানোর পর অতিরিক্ত পণ্যবাহী ট্রাকগুলো ফেরি দিয়ে যাতায়াত করছে। সম্প্রতি পটুয়াখালীর পায়রাকুঞ্জ ফেরিঘাটেছবি: প্রথম আলো

পটুয়াখালীর পায়রা সেতুর টোল প্লাজায় ওজন মাপার যন্ত্র (ওয়ে স্কেল) বসানোর পর থেকে পণ্যবাহী ট্রাক চলাচল কমছে। অতিরিক্ত পণ্যবাহী বড় ট্রাকগুলো ওয়ে স্কেলের জরিমানা এড়াতে বিকল্প সড়ক ব্যবহার করছে। এতে একদিকে সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, অন্যদিকে পটুয়াখালী-মির্জাগঞ্জটি আঞ্চলিক সড়কটি বেহাল হয়ে পড়েছে।

১ হাজার ১১৮ কোটি টাকা ব্যয়ে পটুয়াখালীর দুমকি উপজেলার লেবুখালী এলাকায় পায়রা নদীর ওপর ১ হাজার ১৭০ মিটার দীর্ঘ সেতুটি নির্মাণ করে সড়ক বিভাগ। ১৯ দশমিক ৭৬ মিটার প্রস্থের সেতুটি ২০২১ সালের ২৪ অক্টোবর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দৃষ্টিনন্দন পায়রা সেতু চালুর পর সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটাসহ দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানী ঢাকার নিরবচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগ গড়ে ওঠে। ব্যবসা-বাণিজ্যসহ যোগাযোগের ক্ষেত্রে আমুল পরিবর্তন ঘটে।

সড়ক ও জনপথ বিভাগ সূত্র জানায়, উদ্বোধনের পর থেকেই সেতু পারাপারে যানবাহনের টোল আদায় চালু হয়। তবে গত বছরের আগস্টে তা সম্পূর্ণ ডিজিটালাইজড করা হয়। পাশাপাশি টোল প্লাজায় ওয়ে স্কেল বসানো হয়। সেখানে ওজন মাপার পরই যানবাহনগুলোকে পারাপারের অনুমতি দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন

সড়ক বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ৬ চাকার ট্রাকের স্বাভাবিক বহন ক্ষমতা হচ্ছে ২২ টন। ১০ চাকার ৩০ টন, ১৪ চাকার ৪০ টন, ১৮ চাকার ৪৭ টন, ২২ চাকার ৪৯ টন এবং ২৬ চাকার ৫২ টন। ২২ টন ওজনের  যানবাহনের জন্য টোল ৩৭৫ টাকা, ৩০ টনের জন্য ৭৫০ টাকা এবং ৪০ থেকে ৫২ টন পর্যন্ত টোল ৯৪০ টাকা হারে নির্ধারণ রয়েছে। এ ওজন সীমার অতিরিক্ত এক টনের জন্য পাঁচ হাজার এবং এর পরবর্তী প্রতি টনের জন্য ১০ হাজার টাকা করে জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।

পটুয়াখালীর দুমকি উপজেলায় অবস্থিত পায়রা সেতুর টোল প্লাজায় বসানো ওয়ে স্কেল বা যানবাহনের ওজন মাপার যন্ত্র
ছবি: প্রথম আলো

সেতুর বদলে ফেরিতে ঝুঁকছেন চালকেরা

টোল প্লাজার কর্মকর্তারা বলছেন, ওয়ে স্কেল বসানোর পর থেকে অধিক মালামাল বোঝাই ট্রাকগুলোকে জরিমানা করা শুরু হয়। এর পর থেকে অতিরিক্ত ওজন বহনের জরিমানা ফাঁকি দিতে বেশির ভাগ ট্রাক পটুয়াখালী-মির্জাগঞ্জ সড়কের পায়রাকুঞ্জ ফেরিঘাট দিয়ে যাতায়াত করছে। এ জন্য প্রায় ২০ কিলোমিটার অতিরিক্ত পথ ঘুরতে হচ্ছে।

সেতুতে ওজন স্কেল বসানোর পর থেকে ভারী ট্রাক, লড়ি এই সেতু পার হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন পায়রা সেতুর টোল অপারেশন ব্যবস্থাপক মো. মইনুল হাসান। তাঁর হিসাবে, বর্তমানে এই সেতু দিয়ে ১০ থেকে ১৫টি ভারী যান পারাপার হচ্ছে। আগে প্রতিদিন শতাধিক ভারী যানবাহন এই সেতু দিয়ে চলাচল করত। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে উল্লেখ করে মইনুল হাসান বলেন, ডিজিটালাইজড পদ্ধতি চালুর পর সেতু থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত ৬ মাসে ৯ কোটি ৯৩ লাখ টোল আদায় হয়েছে। তবে সব পণ্যবাহী যানবাহন এই সেতু ব্যবহার করলে রাজস্ব আদায় আরও বাড়ত।

আরও পড়ুন
পায়রা সেতুতে সর্বোচ্চ ওজন সীমার তালিকা টানিয়ে দেওয়া হয়েছে সেতুর টোল প্লাজায়
ছবি: প্রথম আলো

সম্প্রতি পটুয়াখালীর পায়রাকুঞ্জ ফেরি ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, পণ্যবাহী বেশ কয়েকটি ট্রাক ফেরি পার হয়ে পটুয়াখালী শহরের দিকে প্রবেশ করছে। ফেরির একজন কর্মচারী প্রথম আলোকে বলেন, আগে এই ফেরিতে দিনে গড়ে ৫ থেকে ১০টি ট্রাক পারাপার হতো। কিন্তু বর্তমানে প্রতিদিন শতাধিক ট্রাক পারাপার হচ্ছে। তরমুজের মৌসুমে দ্বিগুণ ট্রাক এই ফেরি ব্যবহার করে বলে জানান তিনি।

ফেরিতে ট্রাক পার করা এক চালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে। বিভিন্ন সেতুর টোলসহ আনুষঙ্গিক ব্যয় বাড়ার কারণে ইতিমধ্যে তাঁরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাই ট্রাকে কিছু বাড়তি পণ্য পরিবহন করে এই অতিরিক্ত খরচ মেটানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু পায়রা সেতু পার হলে অতিরিক্ত ওজনের জন্য জরিমানা দিতে হবে। এ কারণে একটু ঘুরতে হলেও বিকল্প সড়ক ব্যবহার করছেন।

বড় ট্রাকে ক্ষতিগ্রস্ত ছোট সড়ক

পটুয়াখালী-মির্জাগঞ্জ সড়কে পাঁচটি বেইলি সেতু আছে। এসব সেতু দিয়ে ১০ টনের বেশি পণ্যবাহী যানবাহন পারাপার ঝুঁকিপূর্ণ উল্লেখ করে সতর্কতামূলক সাইনবোর্ডও দিয়েছে সড়ক বিভাগ। কিন্তু এরপরও ভারী ট্রাক চলাচল করছে বলে জানিয়েছেন পটুয়াখালী সড়ক ও জনপথ বিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলী মো. নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ভারী ট্রাক চলাচলের কারণে সড়কের কিছু অংশ ধসে গিয়ে যানবাহন চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।

সম্প্রতি সরেজমিন দেখা যায়, পটুয়াখালী শহরের প্রবেশদ্বার চৌরাস্তা থেকে পায়রাকুঞ্জ ফেরিঘাট এবং ফেরি পার হয়ে মির্জাগঞ্জের সুবিদখালী পর্যন্ত প্রায় ১০ কিলোমিটার আঞ্চলিক সড়কটি জরাজীর্ণ। বিভিন্ন স্থান ভেঙে রয়েছে। কোথাও সড়কের দুই পাশ ডেবে গেছে। ভারী যানবাহন চলাচলের কারণে পুরো সড়ক এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানালেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

পটুয়াখালীর দুমকিতে অবস্থিত দৃষ্টিনন্দন পায়রা সেতু
ছবি: প্রথম আলো

পটুয়াখালী-মির্জাগঞ্জ আঞ্চলিক সড়কে পাঁচ থেকে সাত টনের বেশি ওজন নিয়ে যানবাহন চলাচলের উপযোগিতা নেই। কিন্তু এরপরও অধিক ওজন নিয়ে ট্রাক-লড়ি চলাচলের কারণে সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পটুয়াখালী সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী এ এম আতিক উল্লাহ। তিনি বলেন, ভারী যানবাহন এই সড়কে চলাচল না করার জন্য নির্দেশনা রয়েছে। গভীর রাতে ভারী ট্রাকগুলো ফেরি পর হয়ে যাচ্ছে। এই সড়কে ভারী চলাচল করায় মজবুত করে নির্মাণ করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও জানান তিনি।

আরও পড়ুন