চিৎকারটা না থাকলে নদীর দুরবস্থা আরও ত্বরান্বিত হতো

জাতীয় নদী রক্ষা আন্দোলনের বরিশাল বিভাগীয় সমন্বয়কারী রফিকুল আলম
ছবি: সংগৃহীত

১৯৮০ সাল থেকে প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসের শেষ রোববার বিশ্ব নদী দিবস পালন করতে শুরু করে ব্রিটিশ কলাম্বিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি। এরপর ২০০৫ সাল থেকে জাতিসংঘের বিভিন্ন সহযোগী সংস্থা দিবসটি পালন করছে। ২০০৫ সালে জাতিসংঘ দিবসটি অনুসমর্থন করে। নদী সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে বাংলাদেশে ২০১০ সাল থেকে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দিবসটি পালন করে আসছে। বিশ্ব নদী দিবস উপলক্ষে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও জাতীয় নদী রক্ষা আন্দোলনের বরিশাল বিভাগীয় সমন্বয়কারী রফিকুল আলম।

প্রশ্ন :

নদীকে ঘিরে দেশে কয়েকটি দিবস পালিত হচ্ছে। এর ফলে নদী সুরক্ষায় কি কোনো সুফল মিলেছে?

রফিকুল আলম: আমাদের দেশে নদী বিষয়ে মূলত তিনটি দিবস বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। যেমন মার্চে নদীকৃত্য দিবস, আগস্টে নদী অধিকার দিবস ও সেপ্টেম্বরে বিশ্ব নদী দিবস। এসব দিবস দেশজুড়ে বেশ ভালোভাবেই পালিত হচ্ছে। আর সুফল যদি ধরেন, তবে সেটা ভিন্ন প্রশ্ন। আগে নদী দখল-দূষণের বিষয়গুলো মানুষের মধ্যে খুব বেশি গুরুত্ব পেত না। অনেকেই মনে করতেন, এত বড় নদী একটু দখল হলে কীই-বা আর ক্ষতি হবে। দূষণের ক্ষেত্রেও এমন উদাসীনতা ছিল। কিন্তু এখন মানুষের বোধের জায়গায় নদীর গুরুত্ব বেড়েছে। নদী বাঁচাতে জনমত তৈরি হয়েছে। এটা কম অর্জন নয়।

প্রশ্ন :

শুধু দিবস পালন করলেই কি নদীর সুরক্ষা হবে?

রফিকুল আলম: অবশ্যই সেটা সম্ভব নয়। এ জন্য কার্যকর পদক্ষেপ দরকার। তবে নদী দিবস পালনের মধ্য দিয়ে দেশের মানুষ এবং সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নদী সম্পর্কে তাদের দায়িত্ব, কর্তব্য স্মরণ করানো এবং নদীর বর্তমান অবস্থাকে তুলে ধরে একটি কার্যকর চাপ তৈরি করা যাচ্ছে। এর মাধ্যমে প্রতিবছরই কিছু না কিছু নীতি ও প্রকল্প গ্রহণ বা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। যদিও এর গতি মন্থর। তারপরও কিছু তো হচ্ছে। চিৎকারটা যদি না থাকত, তাহলে নদীর দুরবস্থা আরও ত্বরান্বিত হতো। দিবস পালন করতে গিয়ে সারা দেশে নদীসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো জনপরিসরে আলোচিত হয় এবং জনমত তৈরি হয়। এর সুফল পায় আমাদের নদীগুলো। সে অর্থে দিবস পালনের গুরুত্ব অপরিসীম।

আরও পড়ুন

প্রশ্ন :

দেশে নদী সুরক্ষায় আইন, রাষ্ট্রের নীতিগত অবস্থান নিয়ে আপনারা সন্তুষ্ট?

রফিকুল আলম: নদী সুরক্ষায় গত এক দশকে রাষ্ট্রের তৎপরতাকে যথেষ্টই বলব। আইন, বিধিবিধান প্রণয়ন, এমনকি নদী রক্ষায় একটি স্বতন্ত্র কমিশন হয়েছে। এটাকে বেশ অগ্রগতিই বলব। তা ছাড়া আমাদের সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে পরিবেশ সুরক্ষায় অঙ্গীকার যুক্ত হয়েছে। ৩০টির বেশি আইন, বিধিমালা ও নীতি রয়েছে, যার সঙ্গে নদীর সুরক্ষার বিষয়টি সরাসরি সম্পর্কিত। নদী নিয়ে কাজ করে, এমন সরকারি সংস্থাও এখন অনেক।

প্রশ্ন :

অসন্তুষ্টি কি নেই?

রফিকুল আলম: হ্যাঁ, সেটা অবশ্যই আছে। তা হলো এসব আইন, বিধিবিধান প্রতিপালনে মাঠপর্যায়ে উদাসীনতা, কালক্ষেপণ, দখলদার প্রভাবশালীদের সঙ্গে আপসকামী মনোভাব—এগুলো বড় অসন্তুষ্টির জায়গা। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছারও ঘাটতি রয়েছে। এখন নদীর জীবন্ত সত্তাকে বাঁচাতে হলে সরকারের শূন্য সহনশীলতা দেখাতে হবে। সরকারের সব শক্তি দিয়েও নদী দখলকারীদের উচ্ছেদ করা যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রয়োজন।

প্রশ্ন :

এই মুহূর্তে যৌথ নদীগুলোর অবস্থা কেমন?

রফিকুল আলম: অবস্থা ভালো নয়। বেশির ভাগ নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে, প্রচুর পলি পড়ছে। উজানে বাঁধ দেওয়া হচ্ছে। শুধু ড্রেজিং করলেই নদী বাঁচবে না, নদীকে বাঁচিয়ে রাখতে সম্মিলিত ও সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে হবে। নদীর সঙ্গে এ অঞ্চলের মানুষের কৃষি, যোগাযোগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সংযোগ বাড়াতে হবে। এত দিন আমরা কেবল নদী থেকে নিয়েছি; নদীর যে নিজস্ব চাহিদা আছে, সেদিকে নজর দিইনি। এখন এই মৃতদশা থেকে নদীকে প্রাণ দিতে হবে।

প্রশ্ন :

আমাদের জীবনে নদীর গুরুত্ব কেমন?

রফিকুল আলম: নদী আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং অর্থনীতির চালিকা শক্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম, যা অন্যান্য উপাদানের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। ২০৩০ সাল পর্যন্ত প্রত্যাশিত বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্যচাহিদা বাড়বে ৫০ শতাংশ, যা ২০৫০ সালে হবে ৭০ শতাংশ, যেখানে হাইড্রো পাওয়ার এবং অন্যান্য নবায়নযোগ্য জ্বালানি সম্পদসহ মোট জ্বালানি চাহিদা বাড়বে ৬০ ভাগ। বর্ধিত কৃষি উৎপাদনের জন্য বিপুল পানি ও জ্বালানি চাহিদা—পানি ব্যবহারকারী ক্ষেত্রগুলোয় প্রতিযোগিতা বাড়বে। এসব বিষয় গভীরভাবে সংযুক্ত। টেকসই উন্নয়নের জন্য যে অর্থনীতি আমাদের প্রয়োজন, সেই অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করতে নদীকে তার হারানো যৌবন ফিরিয়ে দিতে হবে। নদী আমাদের প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গেও অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।