শুধু চিকিৎসক নয়, মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে চান শ্রাবণী

মা-বাবার সঙ্গে শ্রাবণী রানী। গতকাল মঙ্গলবার ঠাকুরগাঁওয়ের সদর উপজেলার ঢোলারহাট ইউনিয়নের উত্তর বোয়ালিয়া গ্রামেছবি: প্রথম আলো

বাবা শ্যামল চন্দ্র বর্মণ শ্যালো ইঞ্জিনের মিস্ত্রি। একখণ্ড বসতভিটে ছাড়া সম্পত্তি বলতে পরিবারটির আর কিছুই নেই। কায়ক্লেশে চলা সংসারে শ্যামলের মেয়ে শ্রাবণী রানী এবার মেডিকেলে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন। তাঁর এমন সাফল্যে গ্রামবাসী ও পরিবারের সবাই আনন্দে আত্মহারা। তবে মেডিকেল কলেজে ভর্তি ও পড়াশোনার খরচসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে পরিবারটির আনন্দ দুশ্চিন্তায় রূপ নিয়েছে।

ঠাকুরগাঁওয়ের সদর উপজেলার ঢোলারহাট ইউনিয়নের উত্তর বোয়ালিয়া গ্রামে শ্যামল চন্দ্র বর্মণ ও তাঁর পরিবারের বসবাস। তিন মেয়ের মধ্যে শ্রাবণী মেজ। বড় মেয়ে শ্যামলী রানী একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বিএসসি ইন নার্সিং কোর্সে পড়াশোনা করছেন। আর ছোট মেয়ে সীমা রানী স্থানীয় একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী। অন্যদিকে শ্রাবণী চলতি বছর মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলে মেধাতালিকায় ৮৫৬তম হয়েছেন। ফলাফলের ভিত্তিতে রংপুর মেডিকেল কলেজে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন তিনি।

গতকাল মঙ্গলবার সকালে শ্রাবণীদের বাড়ি গিয়ে পরিবারের কোনো সদস্যকেই পাওয়া গেল না। প্রতিবেশী ভারতী রানী জানালেন, শ্রাবণীর বাবা শ্যামল চন্দ্র কাজে গেছেন। আর মা ও দুই বোনকে নিয়ে আলুর খেতে গেছেন শ্রাবণী। নিজেদের জমি না থাকায় পড়ালেখার খরচ চালাতে বর্গা চাষ করেন তাঁরা। মা আর তিন মেয়ে মিলে সেখানে চাষাবাদ করে যেটুকু ফসল পায়, তা দিয়েই মেয়েদের পড়ালেখার খরচ চলে। এসব কথার এক পর্যায়ে তিন মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন শ্রাবণীর মা সুভাসী রানী।

সুভাসী রানী জানান, শ্যালো মেরামতের টাকায় তিন মেয়ের পড়ালেখা চলছিল না। শেষে নিজেই এ বছর চুক্তিতে জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ শুরু করেন। এক বিঘায় বছর চুক্তিতে জমি বর্গা নিতে মালিকপক্ষকে ৩৩ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। জমিতে ধান, মিষ্টিকুমড়া ও মরিচ চাষ করা হয়েছিল। এখন সেখানে আলুর আবাদ করা হচ্ছে।

এখন স্বপ্নের দ্বারপ্রান্তে আসতে পেরেছি। এ জন্য অনেক বাধা পার হতে হয়েছে। স্কুল-কলেজের শিক্ষকেরা সহযোগিতা না করলে এটা কিছুতেই সম্ভব ছিল না।
শ্রাবণী রানী , শিক্ষার্থী

জানতে চাইলে শ্রাবণী বলেন, ২০২২ সালে ঢোলারহাট এস সি উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও ২০২৪ সালে ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছেন। স্কুল থেকেই শিক্ষকেরা তাঁর বেতন ও টিউশন ফি নিতেন না। উপবৃত্তি আর বাবার আয়ের পাশাপাশি মা আর নিজেদের ঘাম-শ্রমে ফলানো ফসল বিক্রি করে চলেছে তাঁর ও বোনদের পড়ালেখার খরচ। ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজে উচ্চমাধ্যমিক পড়ার সময় কয়েকটি বিষয়ে তাঁকে প্রাইভেট পড়তে হয়েছে। তবে শিক্ষকদের চাহিদামতো বেতন দিতে পারেননি। এমনকি মেডিকেলে ভর্তি কোচিং করতে ২০ হাজার টাকা ধার করেছিলেন তাঁর মা। পরে জমির ফসল বিক্রি করে সেই টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।

আলাপের এ পর্যায়ে শ্রাবণী বলেন, ‘এখন স্বপ্নের দ্বারপ্রান্তে আসতে পেরেছি। এ জন্য অনেক বাধা পার হতে হয়েছে। স্কুল-কলেজের শিক্ষকেরা সহযোগিতা না করলে এটা কিছুতেই সম্ভব ছিল না।’

শ্রাবণী হামাক হতাশ করেনি। ডাক্তারি পড়াবা নাকি অনেক টাকা লাগিবে। কুনঠে এতলা টাকা পামো?
শ্যামল চন্দ্র বর্মণ, শ্রাবণীর বাবা

মেয়েদের পড়াশোনার ব্যাপারে চেষ্টা করে হতাশ হননি বলে জানিয়েছেন শ্যামল চন্দ্র বর্মণ। তাঁর ভাষ্য, ‘শ্রাবণী হামাক হতাশ করেনি। ডাক্তারি পড়াবা নাকি অনেক টাকা লাগিবে। কুনঠে এতলা টাকা পামো?’ বলতে বলতে তাঁর গলা ধরে আসে। নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ‘জোগাড় হয়ে যাইবে। দরকার পরিলে ভিটাখান বেচায় দিম।’

একপর্যায়ে শ্রাবণীদের বাড়িতে আসেন ঢোলারহাট এস সি উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মার্চেল্লো দাস। সেখান থেকেই মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়েছেন তিনি। এই শিক্ষকের মতে, পড়ালেখার প্রতি টান আর নিখাদ চেষ্টাই শ্রাবণীকে চিকিৎসক হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। আর পরিবারের সদস্যদের ভূমিকাও কম নয়, অভাবের সংসারে মেয়েদের পড়ালেখা চালাতে গিয়ে তাঁর মা ফসলি জমিতে কাজ করে যাচ্ছেন।

ফেরার সময় হঠাৎ এই প্রতিবেদককে ডেকে নিজের জীবনের আরেকটি ইচ্ছার কথা জানান শ্রাবণী। তিনি বলেন, ‘আশীর্বাদ করবেন। নিজেকে শুধু যেন চিকিৎসক নয়, মানুষ হিসেবেও গড়ে তুলতে পারি।’