উৎসমুখ খনন না করায় ব্রহ্মপুত্রে জেগেছে চর
খননকাজ শুরুর চার বছরেও নাব্যতা ফেরেনি ময়মনসিংহে ব্রহ্মপুত্র নদে। উল্টো নদের বুকে ছোট ছোট চর জেগে উঠেছে। শুষ্ক মৌসুমে হেঁটেই পার হওয়া যায় নদ। নাগরিক সমাজের অভিযোগ, খননকাজ পরিকল্পিতভাবে হচ্ছে না। যমুনা নদীর সঙ্গে ব্রহ্মপুত্র নদের সংযোগস্থল বা উৎসমুখ খনন না করায় প্রকল্পের সুফল পাওয়া যাচ্ছে না।
খননের নামে ব্রহ্মপুত্রকে মেরে ফেলা হচ্ছে, এমন অভিযোগ তুলে গত শুক্রবার নদের বুকে হাঁটুপানিতে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানান ময়মনসিংহ শহর ও কয়েকটি উপজেলা থেকে আসা তরুণ–তরুণীরা। ‘মৃতের চিৎকার’ শিরোনামে প্রতীকী ওই কর্মসূচিতে তাঁরা বিষাদের গান গেয়ে প্রতিবাদ জানান।
সর্বশেষ গত শনিবার ‘জনউদ্যোগ’ নামের একটি নাগরিক সংগঠন নদের বিভিন্ন জায়গা পরিদর্শন করে খননকাজের অসংগতি অনুসন্ধান করে। পরে প্রতিকার চেয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন জেলা প্রশাসনকে দেওয়া হবে বলে জানান তাঁরা।
বর্ষায় ব্রহ্মপুত্রে প্রচুর পলি ঢোকে। শুধু এখানে-সেখানে মাটি কাটলে, খনন করলে কাজ হবে না। দীর্ঘ মেয়াদে সুফল পেতে হলে খননের সঙ্গে নদীশাসনকে যুক্ত করতে হবে।আইনুন নিশাত, নদী ও জলবায়ুবিশেষজ্ঞ
ব্রহ্মপুত্র নদের সংযোগস্থলে খনন প্রয়োজন—নাগরিক সমাজের এ দাবি সমর্থন করে নদী ও জলবায়ুবিশেষজ্ঞ এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত প্রথম আলোকে বলেন, বর্ষায় ব্রহ্মপুত্রে প্রচুর পলি ঢোকে। শুধু এখানে-সেখানে মাটি কাটলে, খনন করলে কাজ হবে না। দীর্ঘ মেয়াদে সুফল পেতে হলে শুধু খননে কাজ হবে না। এ জন্য খননের সঙ্গে নদীশাসনকে যুক্ত করার তাগিদ দেন তিনি।
ময়মনসিংহে ব্রহ্মপুত্র নদের খননকাজ শুরু হয় ২০১৯ সালে। নাগরিক সমাজের অভিযোগ, নদের সংযোগস্থল বা উৎসমুখ খনন না করায় খননকাজের সুফল মিলছে না। এ ছাড়া নদের পুরোটা খনন না করে অপরিকল্পিতভাবে প্রস্থে মাত্র ১০০ মিটার খনন করা হচ্ছে। খননের পর নদের পাশে বালু রাখা হচ্ছে, বর্ষার সময় যা আগের জায়গায় গিয়ে পড়ছে।
খননের দায়িত্বে থাকা বিআইডব্লিউটিএর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মহসিন মিয়া বলেন, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রের সংযোগস্থলের বিষয়টি তাঁদের পরিকল্পনায় আছে। চলতি বছরই সেখানে খননকাজ করা হবে। টোক থেকে ময়মনসিংহের পাটগুদাম এলাকার সেতু পর্যন্ত চলতি বছরের জুলাইয়ের মধ্যে খননকাজ শেষ হবে। এরপর আর নাব্যতা–সংকট থাকবে না বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে নদ খননের কাজটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, ব্রহ্মপুত্র নদ খননের উদ্দেশ্য সারা বছর যাতে নদে নাব্যতা বজায় থাকে এবং যাত্রী ও পণ্যবাহী নৌযান চলাচল করতে পারে। পাশাপাশি স্থানীয় কৃষি ও মৎস্য সম্পদ উন্নয়নে যাতে নদটি ভূমিকা রাখতে পারে। প্রকল্পের মাধ্যমে ব্রহ্মপুত্রের মোট ২২৭ কিলোমিটার অংশ খনন করা হবে। জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জে ব্রহ্মপুত্রের উৎসমুখ থেকে কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার টোক পর্যন্ত ২২৭ কিলোমিটার নদ। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয় ২ হাজার ৭৬৩ কোটি টাকা।
গত শনিবার ময়মনসিংহ শহরে নদের কাছারিঘাট ও বিজিবি ক্যাম্প এলাকায় সরেজমিনে দেখা গেছে, নদের বুকে বিভিন্ন জায়গায় চর জেগে উঠেছে। কিছু কিছু এলাকার বাসিন্দাদের হেঁটে ব্রহ্মপুত্র পার হতে দেখা যায়।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও নাগরিক সংগঠন জনউদ্যোগের উপদেষ্টা অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘২০০১ সাল থেকে আমি ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে বসবাস করছি। একসময় শুকনা মৌসুমে নৌকা চলত। কিন্তু এ বছর আর চলছে না। ব্রহ্মপুত্রপাড়ের একজন বাসিন্দা হিসেবে আমি সাক্ষী যে বিজিবি ক্যাম্প এলাকায় সঠিকভাবে খননই হয়নি। সঠিকভাবে খনন না হলে উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হবে কীভাবে?’
ময়মনসিংহ জেলা নাগরিক আন্দোলন কমিটি ২০০৯ সালে প্রথম সরকারের কাছে নদ খননের দাবি ও প্রস্তাব তুলে ধরে। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী নুরুল আমিন কালাম প্রথম আলোকে বলেন, ২০০৯ সালের ৫ ডিসেম্বর ৩৩ সদস্যের একটি দল জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জে ব্রহ্মপুত্র নদের উৎসমুখ পরিদর্শন করে। সে দলে তিনিও ছিলেন। সেখানে যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রের সংযোগস্থল। যমুনার পানি ব্রহ্মপুত্রে প্রবাহিত হওয়ার কথা থাকলেও সংযোগস্থলটি নালার মতো সরু এবং যমুনার চেয়ে ব্রহ্মপুত্রের উৎসমুখ উঁচু হওয়ায় পানি ব্রহ্মপুত্রে আসতে পারে না। সেখানকার ভিত্তিও চিত্র ধারণ করে ১২ ডিসেম্বর ময়মনসিংহ জেলা পরিষদ মিলনায়তনে তৎকালীন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানকে আমন্ত্রণ জানিয়ে সেই ভিডিও দেখানো হয়। পাশাপাশি যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রের সংযোগস্থল খননের দাবি জানানো হয়।
প্রকৌশলী নুরুল আমিন আরও বলেন, ২০১৯ সালে ব্রহ্মপুত্র নদের খননকাজ শুরু হলে প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা দেখা করেন। তাঁরা ২০০৯ সালের অভিজ্ঞতা তাঁদের জানান। কিন্তু তাঁরা সংযোগস্থলে খনন না করে উজানে খনন করছেন। এ জন্য খননকাজের সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রস্তাবনা ছিল আগে জামালপুরের সংযোগস্থল খনন করে ব্রহ্মপুত্রে পানির প্রবাহ নিশ্চিত করা। এরপর পরিকল্পিতভাবে প্রয়োজনমাফিক খনন করা।’