সান্ত্বনা দিতে আসা মানুষের কাছে সুরাইয়ার নানির প্রশ্ন, ‘নাতনিক ফিরায় দিবা পারিবেন?’

প্রতিবেশীদের সান্ত্বনায় কান্না থামছে না সুরাইয়ার নানি মহিফুল বেগমের। ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলার বাচোর ইউনিয়নে
ছবি: প্রথম আলো

জন্মের পর থেকে একটি বেলার জন্যও সুরাইয়াকে চোখের আড়াল করেননি মা মিনারা বেগম। গতকাল বুধবার সন্ধ্যা থেকে সেই সুমাইয়া তার পাশে নেই। আর কোনো দিন সে ফিরবে না মায়ের কোলে।

ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলার বাচোর ইউনিয়নের মীরডাঙ্গী আশ্রয়ণ প্রকল্পের গ্রামের মো. বাদশাহর সাত মাস বয়সী মেয়ে সুরাইয়া গতকাল নির্বাচনী সহিংসতায় নিহত হয়। সুরাইয়ার মা শেষ সময়ে ভোট দিয়ে ফলের অপেক্ষায় সেখানে থেকে গিয়েছিলেন। সে সময়ই এ ঘটনা ঘটে।

আজ বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার দিকে মো. বাদশাহর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে স্বজনদের মাতম চলছে। গ্রামবাসী পরিবারের সদস্যদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। সে সময় সুরাইয়ার নানি মহিফুল বেগম চিৎকার করে কেঁদে ওঠেন আর বলতে লাগলেন, ‘এলা এসব কহে কী হবে? তোমরা হামার নাতনিক ফিরায় দিবা পারিবেন?’ বলেই আবার কাঁদতে লাগলেন।

পাশেই আরেক ঘরের বারান্দায় বসে মাতম করছিলেন সুরাইয়ার দাদি (বাদশার চাচি) মোহিরন খাতুন। তিনি বলেন, ‘কী সুন্দর ভোট হয়ে গেইল। কোনো ঝামেলা নাই। শেষ বেলায় মারামারি হবে কাউ বুঝিবে। ওই দেখিতে যায়েই কাল হইল।’

সুরাইয়ার বাবা বাদশাহ ও মা মিনারা ঘটনার পরই অসুস্থ হয়ে পড়েন। আজ রানীশংকৈল স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে তাঁদের সঙ্গে কথা হয়। মিনারা বলেন, ‘ওক (সুরাইয়া) আর বুকে জড়াইয়া ঘুমাবা পারিমোনি।’ বলতে বলতে গলা ধরে আসে তাঁর। একপর্যায়ে মূর্ছা যান।

আরও পড়ুন

গতকাল রানীশংকৈল উপজেলার তিনটি ইউপির ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে। উপজেলার বাচোর ইউপির ভাংবাড়ি ভিএফ নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ ও গণনা শেষে ফলাফল ঘোষণা করা হয়। ঘোষিত ফলে ইউপি সদস্য পদে বাবুল হোসেন ৪৯৩ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। অপর ৩ প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর মধ্যে আজাদ আলী ৪৪২ ভোট, খালেদুর রহমান ২৪৫ ভোট ও কামালউদ্দিন ২১৩ ভোট করে পেয়েছেন। কিন্তু ওই ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেন পরাজিত প্রার্থীর সমর্থকেরা। পরে তাঁরা লাঠিসোঁটা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলা চালায়। এ সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাদের কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে। এতে কাজ না হওয়ায় হামলাকারীদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে পুলিশ।

সন্তানের মৃত্যুর পর অসুস্থ হয়ে পড়েন বাবা বাদশাহ ও মা মিনারা। তাঁদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়
ছবি: প্রথম আলো

সে সময় মাথায় আঘাত পেয়ে সুমাইয়া নিহত হয়। প্রতিবেশীরা জানান, ভোটের ফলাফল জানতে সুরাইয়াকে নিয়ে তার মা ভোটকেন্দ্রে এসেছিলেন। সেখানে নির্বাচনী সহিংসতায় শিশু নিহত হওয়ার ঘটনায় এলাকাবাসীর মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেয়। তারা রাতেই সুরাইয়ার লাশ নিয়ে বিক্ষোভ করে রানীশংকৈল আঞ্চলিক মহাসড়ক অবরোধ করে। পরে পুলিশ এসে তাদের নিয়ন্ত্রণ করে।

এ ঘটনায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) রামকৃষ্ণ বর্মণকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক মাহবুবুর রহমান। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা। আজ দিনাজপুর এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্ত হয়েছে।

পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ফলাফল ঘোষণার পর পরাজিত প্রার্থীর সমর্থকেরা ভোট গ্রহণের দায়িত্বে থাকা লোকজনের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। আত্মরক্ষায় পুলিশ গুলি ছোড়ে। পরে তাঁরা জানতে পেরেছেন সে সময় এক শিশু মারা গেছে। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সারা দিনের প্রচেষ্টায় সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিলাম। নির্বাচন শেষে এমন একটি ঘটনা সত্যি কষ্টকর। এ ছাড়া পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় মামলার প্রক্রিয়া চলছে।’