‘প্রশাসনের ব্যর্থতায় এত বড় সংঘর্ষ’

শিক্ষার্থীরা ও ব্যবসায়ী উভয় পক্ষই বলছে, প্রশাসনিক ব্যর্থতার কারণে ছোট ঘটনাটি বড় হয়ে গেল। তারা উদ্যোগ নিলে এ ঘটনা এড়ানো যেত। 

শিক্ষার্থীরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক ছেড়ে চারুকলা রেলক্রসিংয়ের লাইনে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন। গতকাল সন্ধ্যার পর
ছবি: প্রথম আলো

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে বাসচালকের তর্কবিতর্কের মতো তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে হওয়া সংঘর্ষের ঘটনায় আহত শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৯০ জন এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাঁদের একজনকে রাখা হয়েছে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ)। অস্ত্রোপচার করা হয়েছে ছয়জনের চোখে। হামলায় ৩০টি দোকানসহ পুলিশ বক্স পুড়ে গেছে।

গত শনিবার রাতের ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজশাহী-নাটোর মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধের মুখে ওই রাতে তিন ঘণ্টা ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে শনিবার রাতেই গতকাল রোববার ও আজ সোমবার—এ দুই দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস–পরীক্ষা বন্ধ ঘোষণা করা হয়। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি।

ঘটনা শোনার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা বিভিন্ন জায়গায় ভাগ হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। কেউ মেডিকেল সেন্টারে গেছেন। উপাচার্য মেয়রকে নিয়ে ঘটনাস্থলে গেছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তাঁদের কোনো গাফিলতি ছিল না।
মো. সুলতান-উল-ইসলাম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য অধ্যাপক
আরও পড়ুন

বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা গতকালও দিনভর নানা কর্মসূচি পালন করেছেন। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে মহাসড়ক থেকে সরে গিয়ে চারুকলার পাশে রেললাইনে অবস্থান নেন। সেখানে অবস্থান নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের বিরুদ্ধে তাঁরা নানা ধরনের স্লোগান দেন। এ সময় তাঁরা বসন্তবরণের জন্য চারুকলার শিক্ষার্থীদের বানানো নানা ধরনের ভাস্কর্য রেললাইনের ওপর এনে আগুন ধরিয়ে দেন। এতে আবার রেলযোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে।

আরও পড়ুন

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক আসাবুল হক রাত আটটার দিকে প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষার্থীরা মহাসড়ক ছেড়ে রেললাইন অবরোধ করতে গেছেন। সেখানে সহকারী প্রক্টরদের পাঠানো হয়েছে। তাঁরা শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন।

এ সংঘর্ষের ঘটনায় বিকেলে নগরের মতিহার থানায় মামলা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এতে বিনোদপুর এলাকার অজ্ঞাত ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এরই মধ্যে তসলিম আলী (৪৫) নামের একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

‘আমরা অনেকক্ষণ ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়েছি। আমরা কোনো ফায়ার ওপেন করিনি। যখন ছাত্ররা দোকানপাটে আগুন দিতে গিয়েছেন, তখন বাধ্য হয়ে মাঝবরাবর কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করেছি, শুধু দুই পক্ষকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য। এর জন্য ছাত্ররা এখন যদি পুলিশের দোষ দেয়, তাতে আমরা মাইন্ড করছি না। তাঁরা তো সাংবাদিকদের ওপরেও হামলা চালিয়েছেন।’
আনিসুর রহমান, রাজশাহী মহানগর পুলিশ কমিশনার

দিনভর বিক্ষোভ

গতকাল সকাল ১০টার দিকে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ভবনের সামনে জড়ো হতে থাকেন। পরে প্রশাসন ভবনে তালা ঝুলিয়ে বেলা পৌনে ১১টার দিকে বিক্ষোভ মিছিল করে প্রথমে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নেন। এ সময় উপাচার্যসহ প্রশাসনের ব্যক্তিরা শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি হয়ে তাঁদের কথা শোনেন। পরে শিক্ষার্থীরা বিনোদপুরের দিকে যেতে চান।

তখন উপাচার্যসহ প্রশাসনের ব্যক্তিরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবাশ বাংলাদেশ মাঠে গিয়ে পুনরায় কথা বলতে চান। সেখানে শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পড়েন তাঁরা। শিক্ষার্থীরা উপাচার্যকে সঙ্গে নিয়ে বিনোদপুর এলাকায় যেতে চান। পরে একপর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনের বারান্দায় উপাচার্যসহ অন্যদের অবরুদ্ধ করা হয়। শিক্ষার্থীদের একটি দল সে সময় ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কে আশপাশের স মিলের কাঠ ও নানা ধরনের ব্যানারের আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকেন।

বেলা একটার পর সিনেট ভবনে ছাত্রলীগসহ ক্যাম্পাসের ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতারা বক্তব্য দেন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে। উপাচার্যও দাবিদাওয়া মেনে নেওয়ার আশ্বাস দেন। প্রায় দেড় ঘণ্টা অবরুদ্ধ থাকার পর ছাত্রলীগের নেতাদের সঙ্গে উপাচার্য তাঁর বাসভবনে প্রবেশ করেন। পরে ধীরে ধীরে শিক্ষার্থীরা চলে যেতে থাকেন। বেলা সাড়ে তিনটার দিকে সাংবাদিক, রাজনৈতিক সংগঠনসহ ছাত্রলীগ আলোচনায় বসে। তাঁরা সাত-আটটি দাবি লিখলেও মতানৈকের কারণে আর উপাচার্যের কাছে জমা দেননি। তবে ক্যাম্পাসের বাম সংগঠনগুলো আলাদা করে দাবিসংবলিত একটি স্মারকলিপি দিয়েছে।

বিকেলেও শিক্ষার্থীদের একটি অংশ ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কে বিক্ষোভ করে। পরে সন্ধ্যার দিকে সেখানে শিক্ষার্থীদের জমায়েত বাড়তে থাকে। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে সেখান থেকে মিছিল করতে করতে চারুকলার দিকে যেতে থাকেন তাঁরা। রাত পৌনে আটটার দিকে তাঁরা চারুকলার পাশে রেললাইনে অবস্থান নেন।

শিক্ষার্থীদের কেন ফিরিয়ে আনা যাচ্ছে না, তাঁরা এখনো রাস্তায় কেন—এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য অধ্যাপক মো. সুলতান-উল-ইসলাম বলেন, শিক্ষার্থীদের সব দাবিদাওয়া মেনে নিয়েছেন তাঁরা। তবু কেন তাঁরা রাস্তায়, তাঁরা কেন সরছে না? তাহলে বোঝা যাচ্ছে তাঁদের দাবিগুলোই মূল কথা নয়, অন্য কিছু হয়তোবা। তিনি শিক্ষার্থীদের শান্ত হওয়ার আহ্বান জানান।

‘প্রশাসন উদ্যোগ নিলে ঘটনা এড়ানো যেত’

শিক্ষার্থীরা ও ব্যবসায়ী উভয় পক্ষই বলছে, প্রশাসনিক ব্যর্থতার কারণে ছোট ঘটনাটি বড় হয়ে গেল। তারা উদ্যোগ নিলে এ ঘটনা এড়ানো যেত।

স্থানীয় লোকজন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তুচ্ছ ঘটনা থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বারবার বড় ঘটনার জন্ম হয়েছে। ৪০ বছর ধরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বাস করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) রাজশাহী জেলার সভাপতি আহমদ সফিউদ্দিন। তিনি বলেন, গত ৩০ বছরে অন্তত পাঁচ-ছয়টি এ রকম বড় ঘটনা ঘটেছে। এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের নিয়ে মাঝেমধ্যেই ওরিয়েন্টেশন হওয়া দরকার।

ছাত্রলীগের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি গোলাম কিবরিয়া জানান, ঘটনার পরপরই তিনি কয়েকজন নেতাকে নিয়ে ঘটনাস্থলে যান। মোটরসাইকেল রেখে এগিয়ে যেতেই ব্যবসায়ীরা তাঁদের ওপর আক্রমণ করেন। তাঁদের সাতটি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করা হয়। দুটি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। তারপর ছাত্ররা দফায় দফায় মার খেয়েছেন, কিন্তু পুলিশ প্রশাসন নীরব ছিল। আর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তৎপর হয়েছে রাত ১০টার পর। গোলাম কিবরিয়া বলেন, ‘পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যথাসময়ে পদক্ষেপ নিলে জানমালের ক্ষতি হতো না।’

বিনোদপুরের ব্যবসায়ীরাও এ ঘটনায় পুলিশ প্রশাসন ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে দায়ী করছেন। নাম না প্রকাশ করার শর্তে তাঁরা বলেন, ঘটনার পর পুলিশ তাঁদের সরিয়ে দেয়। এ সময় পুলিশ নীরব ভূমিকা পালন করে। তাঁরা ভয়ে সরে যান। ছাত্রদের কারা ইটপাটকেল মেরেছে, তাঁরা তা জানেন না।

রাত ৯টার দিকে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এ এইচ এম খায়রুজ্জামান। তিনি বলেন, ভেতরে যতক্ষণ ছাত্রলীগ নেতৃত্ব দিচ্ছিল ততক্ষণ পর্যন্ত সাধারণ ছাত্ররা নিয়ন্ত্রণে ছিলেন। পরে ছাত্রশিবির ও ছাত্রদল ভেতরে ঢুকে উসকানি দিয়ে পেট্রলবোমা নিক্ষেপ করে। এতে ব্যবসায়ীরা ভয় পেয়ে যান।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে তো জেলা প্রশাসকের যাওয়ার নজির নেই, উল্লেখ করে জেলা প্রশাসক আব্দুল জলিল বলেন, বাইরে থেকেই তাঁরা চেষ্টা করেছেন। একপর্যায়ে বিজিবি নামিয়ে দিয়ে চলে এসেছেন।

কোনো গাফিলতি ছিল না

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রাত ১০টার দিকে যখন পুলিশ বিনোদপুর এলাকার লোকজনকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সরিয়ে দেওয়ার জন্য একটি কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে, সেই সময় ছাত্ররা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। এ সময় পুলিশ পিছু হটতে বাধ্য হয়।

তখন বাজারের দোকানপাটে আগুন লাগানোর ঘটনা ঘটে। তার আগেই পোড়ানো হয় পুলিশ বক্স ও পাশের কয়েকটি দোকান। রাত সাড়ে ১০টার দিকে পুলিশ আবার সংঘবদ্ধ হয়ে কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে ছাত্রদের বিনোদপুর বাজার থেকে ধাওয়া দিয়ে ক্যাম্পাসের ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়। রাত পৌনে ১১টা পর্যন্ত পুলিশের সঙ্গে তাদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া চলতে থাকে।

পুলিশ ২০ থেকে ৩০টি কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে। এতে ব্যাপক ধোঁয়ার সৃষ্টি হলে বেশ কিছু শিক্ষার্থী আহত হয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারের দিকে যায়। রাত ১১টার দিকে শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ প্রশাসন ভবনের সামনে অবস্থান নেয়।

রাজশাহী মহানগর পুলিশ কমিশনার আনিসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা অনেকক্ষণ ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়েছি। আমরা কোনো ফায়ার ওপেন করিনি। যখন ছাত্ররা দোকানপাটে আগুন দিতে গিয়েছেন, তখন বাধ্য হয়ে মাঝবরাবর কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করেছি, শুধু দুই পক্ষকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য। এর জন্য ছাত্ররা এখন যদি পুলিশের দোষ দেয়, তাতে আমরা মাইন্ড করছি না। তাঁরা তো সাংবাদিকদের ওপরেও হামলা চালিয়েছেন।’

এ বিষয়ে কথা বলার জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য গোলাম সাব্বির সাত্তারের সঙ্গে কথা বলার জন্য তাঁর মুঠোফোনে কল দেওয়া হলেও তিনি সাড়া দেননি। তবে সহ-উপাচার্য অধ্যাপক মো. সুলতান-উল-ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনা শোনার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা বিভিন্ন জায়গায় ভাগ হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। কেউ মেডিকেল সেন্টারে গেছেন। উপাচার্য মেয়রকে নিয়ে ঘটনাস্থলে গেছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তাঁদের কোনো গাফিলতি ছিল না।

তদন্ত কমিটি গঠন

ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। গতকাল সন্ধ্যায় কমিটি গঠনের বিষয়টি নিশ্চিত করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তরের প্রশাসক অধ্যাপক প্রদীপ কুমার পাণ্ডে। তিনি বলেন, ঘটনা তদন্তে সহ-উপাচার্য অধ্যাপক হুমায়ুন কবীরকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামীকাল (আজ) অফিস সময়ে কমিটিকে নির্দেশনা দিয়ে চিঠি ইস্যু করা হবে।

অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেন, কমিটিতে সদস্য হিসেবে রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রক্টর ও রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক তারিকুল হাসান ও সহকারী প্রক্টর আরিফুর রহমান।

এদিকে এ ঘটনায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিও নিন্দা প্রতিবাদ জানিয়ে গণমাধ্যমে বিবৃতি পাঠিয়েছে। তারা শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় জড়িতদের বিচার দাবি করেছে।