অপরিকল্পিত নদী খনন, বেড়েছে অগ্নিকাণ্ডসহ নানা ঝুঁকি

সুন্দরবনের নদী-খালে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে না আনলে এ ধরনের অগ্নিকাণ্ড থেকে সুন্দরবনকে রক্ষা করা কঠিন হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

ভোলা নদী খননের পর মাটি ফেলা হয়েছিল পাড়েই। এ কারণে উঁচু জোয়ারেও তা টপকে পানি প্রবেশ করতে পারছে না বনভূমিতে। গতকাল সুন্দরবনের আমোরবুনিয়া এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

সুন্দরবনে গত দুই দশকে অন্তত ২৫ বার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর সবই ঘটেছে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগে চাঁদপাই ও শরণখোলা রেঞ্জের লোকালয়-সংলগ্ন ভোলা ও মরা ভোলা নদীপাড়ের বনভূমিতে।

বন বিভাগের কর্মকর্তারাসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এখানে বনের ভূমি উঁচু হয়ে গেছে; জোয়ারে পানি প্রবেশ করতে পারে না। ফলে ম্যানগ্রোভের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হারাতে বসেছে বনের এই অংশ।

এ সম্পর্কে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক ও সুন্দরবন রক্ষায় আমরার সমন্বয়কারী নূর আলম শেখ বলেন, সুন্দরবনের সাধারণ বৈশিষ্ট্যই হলো জোয়ারে এই বনভূমি ডোবে এবং ভাটায় ভাসে। সে অর্থে দিন-রাতে দুইবার প্লাবিত হয় এই বনভূমি। এমনটা হলে এখানে শুকনা পাতা থাকত না। তখন কেউ যদি আগুন লাগানোর চেষ্টাও করতেন, তা জ্বলত না।

আরও পড়ুন
সুন্দরবনের নদী-খালে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে না আনলে এ ধরনের অগ্নিকাণ্ড থেকে সুন্দরবনকে রক্ষা করা কঠিন হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

নূর আলম শেখ আরও বলেন, নানা কারণে বনের নদী-খালগুলোও পলি জমে সংকুচিত হয়ে গেছে। ভোলা নদী একসময় একদমই শুকিয়ে গিয়েছিল। সেই নদী প্রায় দুই দশক আগে খননযন্ত্র দিয়ে কাটা হয়। তখন মাটি কেটে ফেলা হয় নদীর দুই পাড়ে; যা বাঁধের মতো হয়ে আছে। ফলে উঁচু জোয়ারেও পানি বনে প্রবেশ করতে পারছে না। এ কারণে শুষ্ক থাকছে বন।

সুন্দরবনের নদী-খালে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে না আনলে এ ধরনের অগ্নিকাণ্ড থেকে সুন্দরবনকে রক্ষা করা কঠিন হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। একই সঙ্গে অগ্নিকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে বনের মধ্যে চোরা শিকারিসহ মানুষের অবাধ যাতায়াত বন্ধের দাবি পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর।

পানিপ্রবাহ না থাকায় ভবিষ্যতে অগ্নিকাণ্ড থেকে বনকে রক্ষা করা কঠিন হবে বলে মনে করেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ওয়াসিউল ইসলাম। তিনি বলেন, বনের মধ্যে পানির প্রবাহ না থাকা বড় একটা ইস্যু হয়ে গেছে। বন বিভাগের সঙ্গে নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের বিভিন্ন শাখা, নদীশাসনের কাজ যাঁরা করেন, তাঁদের সবার একটা সমন্বয় দরকার। কারণ, আগের মতো প্রকল্প নিয়ে যদি মাটি কেটে বনের মধ্যে ফেলা হয় এবং বনকে যদি উঁচু করে দেওয়া হয়, তবে ম্যানগ্রোভের জন্য যে পরিবেশ লাগে, সেটা নষ্ট হবে। তখন নতুন প্রকল্পেও কোনো লাভ হবে না।

আরও পড়ুন
সুন্দরবনের সাধারণ বৈশিষ্ট্যই হলো জোয়ারে এই বনভূমি ডোবে এবং ভাটায় ভাসে। সে অর্থে দিন-রাতে দুইবার প্লাবিত হয় এই বনভূমি। এমনটা হলে এখানে শুকনা পাতা থাকত না। তখন কেউ যদি আগুন লাগানোর চেষ্টাও করতেন, তা জ্বলত না।
নূর আলম শেখ, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক ও সুন্দরবন রক্ষায় আমরার সমন্বয়কারী

সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকার প্রবীণ বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভোলা নদী একসময় এক কিলোমিটারের বেশি প্রশস্ত ছিল। খননের পর তা সরু হয়ে গেছে। অনেক জায়গায় নদীর প্রস্থ মাত্র ১৫-২০ ফুট। ভাটায় তা-ও আবার পানি থাকে না।

মধ্য আমোরবুনিয়া গ্রামের লতিফ হাওলাদার (৭১) আগে সুন্দরবনে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এখন বয়সের কারণে আর বনে যেতে পারেন না। তিনি বলেন, ‘জঙ্গল তো আর আগের মতো নাই। মাছ-পোনা কম। বছর বছর পোড়ে, আমরা খাব কী। নদী কাইটে মাটি যে পাশে রাখল, এই জন্যিই (জন্যই) পানি ঢোকে না বনে।’

সর্বশেষ গত শনিবার সুন্দরবনের আমোরবুনিয়া এলাকায় আগুন লাগে। এরপর বন বিভাগ, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হয়। পরে রোববার ভোর থেকে ফায়ার সার্ভিস, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড ও বন বিভাগের নিজস্ব ফায়ার ইউনিট আগুন নেভানো শুরু করে। সোমবার সকাল থেকে সবার সম্মিলিত চেষ্টায় আরও জোরেশোরে আগুন নেভানোর কাজ শুরু হয়। দুপুর নাগাদ আগুন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয় ফায়ার সার্ভিস।

আরও পড়ুন

শনিবার থেকেই ঘটনাস্থলে আছেন মোরেলগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এম এম তারেক সুলতান। বনের পাড় উঁচু থাকায় পানি প্রবেশ না করার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে ভাবা দরকার। যদি পাড় উঁচু না থাকলে জোয়ারের পানিতে বন প্লাবিত হতো, তবে আগুনের ঝুঁকি নিশ্চয়ই কমে আসত।

বন বিভাগের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, আগে নদী খননের সময় বিষয়গুলো নিয়ে গভীরভাবে ভাবা হয়নি। নদীর পাড়ে মাটি রেখে এমন করে প্লাবনভূমি নষ্ট করা ঠিক হয়নি।

জানতে চাইলে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) কাজী মুহাম্মদ নুরুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে। বৃষ্টিও শুরু হয়েছে। আশা করা যায় আগুন এখন পুরোপুরি নিভে যাবে। ইতিপূর্বে অগ্নিকাণ্ডে ঘটনাগুলোর পর তদন্ত কমিটির সুপারিশেও নদী-খাল খননের কথা বলা হয়েছে। আগামী বছর ভোলা নদীসহ কয়েকটি খাল খনন হবে। এখন সামনে নিশ্চয়ই বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে তা পরিকল্পিতভাবে করা হবে।

আরও পড়ুন