কক্সবাজার উপকূলের ৫ লাখ মানুষকে সরানোর প্রস্তুতি

ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে কক্সবাজার সৈকতের সমুদ্র উত্তাল হয়ে পড়েছে। লাল নিশানা তুলে সমুদ্রে পর্যটকদের গোসল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আজ সকালেছবি: প্রথম আলো

ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে আজ রোববার সকাল থেকে কক্সবাজার সমুদ্র উপকূল প্রচণ্ড উত্তাল হয়ে পড়েছে। ঢেউয়ের উচ্চতা স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েক ফুট বৃদ্ধি পেয়ে উপকূলে আছড়ে পড়ছে। কক্সবাজার শহরের নাজিরারটেক, কলাতলীসহ বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। বিকেল চারটার আগে উপকূলের কয়েক স্থানে অতি ঝুঁকিতে থাকা অন্তত পাঁচ লাখ মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে সকাল থেকে প্রচারণা চালানো হচ্ছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের সর্বশেষ বুলেটিনে কক্সবাজার উপকূলকে ৯ নম্বর মহাবিপৎসংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে কক্সবাজার বিমানবন্দরে উড়োজাহাজের ওঠানামা সারা দিনের জন্য বন্ধ করা হয়েছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের সর্বশেষ বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ঘূর্ণিঝড় রিমাল আজ সকাল ৬টায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৪০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৩০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে, মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৩৩০ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ২৯৫ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থান করছিল। এটি আরও উত্তর দিকে এগিয়ে ঘনীভূত হতে পারে।

আরও পড়ুন

বঙ্গোপসাগর প্রচণ্ড উত্তাল হলেও সকাল থেকে কক্সবাজারের আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ছিল। বেলা ১১টা পর্যন্ত হালকা বাতাসের সঙ্গে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বাতাসের গতি ও বৃষ্টি বাড়তে থাকে। জেলা প্রশাসন ও কক্সবাজার পৌরসভার উদ্যোগে সকাল থেকে সমুদ্রসৈকত এবং নাজিরারটেক উপকূলে প্রচারণা শুরু করে লোকজনকে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে বলা হচ্ছে।

নাজিরারটেক উপকূলে ৭০০ শতাধিক শুঁটকি মহালে কাজ করেন ৬০ হাজারের বেশি শ্রমজীবী মানুষ। এর ৮০ শতাংশ জলবায়ু উদ্বাস্তু, ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড়ে জেলার কুতুবদিয়া, মহেশখালী, পেকুয়া, চকরিয়াতে ঘরবাড়ি বসতভিটা হারিয়ে কক্সবাজার পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের নাজিরারটেক, কুতুবদিয়াপাড়া, সমিতিপাড়া, ফদনারডেইলসহ ১৭টি গ্রামের সরকারি জমিতে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছেন। ঘূর্ণিঝড়ের সংকেত পড়লে এসব মানুষের আতঙ্ক বেড়ে যায়। সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে অধিকাংশ গ্রাম প্লাবিত হয়, ঝোড়ো হাওয়ায় লন্ডভন্ড হয় ঘরবাড়ি। ঘূর্ণিঝড় রিমাল নিয়েও লোকজনের আতঙ্কে শেষ নেই।

আরও পড়ুন

ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কে এলাকার লোকজনকে সকাল থেকে সতর্ক করছেন পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আকতার কামাল। সকাল ১০টায় তিনি ঘটনাস্থল থেকে প্রথম আলোকে বলেন, ঘূর্ণিঝড় রিমাল যদি সন্ধ্যার দিকে আঘাত হানে তাহলে শ্রমজীবী মানুষগুলোর ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বেশি। কারণ তখন সমুদ্রে জোয়ার থাকবে। জলোচ্ছ্বাস ও ঝোড়ো হাওয়া একসঙ্গে আঘাত হানলে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়। এসব বিষয় নিয়ে লোকজনকে সতর্ক করতে সকাল থেকে উপকূলে প্রচারণা চালানো হচ্ছে।

কক্সবাজারের উখিয়ার লম্বাশিয়া আশ্রয়শিবিরে ঘূর্ণিঝড় সতর্কীকরণ নিশানা তুলছেন স্বেচ্ছাসেবীরা। আজ দুপুরে
ছবি: প্রথম আলো

সাগর দ্বীপ কুতুবদিয়া, মহেশখালী, সেন্ট মার্টিন দ্বীপসহ অন্য উপকূলগুলোয়ও সকাল থেকে জোরেশোরে প্রচারণা চলছে জানিয়ে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান প্রথম আলোকে বলেন, দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৪টার মধ্যে অতি ঝুঁকিতে থাকা অন্তত পাঁচ লাখ মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে আনার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে একাধিক টিম মাঠে কাজ করছে। জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ৬৩৮টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। মাঠে তৎপর রয়েছে সিপিপি ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ১০ হাজার ৮০০ জন স্বেচ্ছাসেবী। পাশাপাশি পুলিশ, র‍্যাবসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা মাঠে রয়েছেন। জরুরি সেবা কার্যক্রমে অংশ নিতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটিও বাতিল করা হয়েছে।

জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান আরও বলেন, কক্সবাজার উপকূলে ৯ নম্বর বিপৎসংকেত জারি করা হলেও পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত রয়েছে। সকাল থেকে থেমে থেমে হালকা বৃষ্টি হচ্ছে। মাঝেমধ্যে রোদও দেখা যাচ্ছে। সাগরে ভাটা থাকায় জলোচ্ছ্বাস তেমন প্রভাব ফেলছে না। এ কারণে বিশেষ করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক দেখে লোকজন ঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে রাজি হচ্ছেন না। তবে সন্ধ্যা ছয়টার দিকে সাগরে জোয়ার শুরু হবে, তা মধ্যরাত পর্যন্ত চলমান থাকবে। এ সময় ঘূর্ণিঝড় রিমাল কক্সবাজারে আঘাত হানলে ক্ষয়ক্ষতি বাড়ার ঝুঁকি রয়েছে। দুর্যোগ মোকাবিলায় জেলা প্রশাসন প্রস্তুত রয়েছে।

আরও পড়ুন

কক্সবাজার বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক গোলাম মর্তুজা প্রথম আলোকে বলেন, ঘূর্ণিঝড় ও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে আজ সকাল সাতটা থেকে বিমানবন্দরে উড়োজাহাজের ওঠানামা বন্ধ রাখা হয়েছে। সারা দিন আর বিমান চলবে না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আগামীকাল সোমবার সকাল থেকে উড়োজাহাজের চলাচল শুরু হতে পারে। কক্সবাজার বিমানবন্দর থেকে ঢাকায় প্রতিদিন ১৪ থেকে ১৬টি ফ্লাইট (বিমান) পরিচালনা হয়।

কক্সবাজার হোটেল গেস্টহাউস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সেলিম নেওয়াজ বলেন, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে সমুদ্রসৈকতে পর্যটকের যাতায়াত সীমিত হয়ে পড়েছে। ৯০ শতাংশ পর্যটক হোটেল কক্ষে অবস্থান করছেন। ঘূর্ণিঝড়ের সংকেত পেয়ে অনেকে গতকাল শনিবার রাতে কক্সবাজার ত্যাগ করেন। বর্তমানে ২০ হাজারের মতো হোটেল, মোটেল, গেস্টহাউসে অবস্থান করছেন। দূরপাল্লার বাসের সংকট এবং বিমান চলাচল বন্ধ হওয়ায় হাজারো পর্যটক বিপাকে পড়েছেন।

সেন্ট মার্টিন দ্বীপের ইউপি চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, সেখানকার পরিস্থিতি বেলা ১১টা পর্যন্ত স্বাভাবিক হলেও বিকেল নাগাদ ঝড়ের গতি বাড়তে পারে। তখন সাগরের পানি অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে দ্বীপের চারদিক প্লাবিত হতে পারে। বিকেলের আগেই দ্বীপের অন্তত সাত হাজার মানুষকে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র এবং বহুতল ভবনের কয়েকটি হোটেলে সরিয়ে আনার প্রস্তুতি চলছে।

আরও পড়ুন