দলিল চালাচালিতে বাড়ছে আলুর দাম

হিমাগারে আলু বাছাইয়ে ব্যস্ত শ্রমিকেরা। গত মঙ্গলবার মুন্সিগঞ্জের সদর উপজেলার রিভারভিউ কোল্ড স্টোরেজে
ছবি: প্রথম আলো

বাজার, হিমাগার—কোথাও আলুর কোনো সংকট নেই। অথচ দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। এমনকি আলুর জন্য প্রসিদ্ধ জেলা মুন্সিগঞ্জেও আলুর দাম বেড়েই চলেছে। ব্যবসায়ীরাই বলছেন, হিমাগারে রাখা আলুর মালিকানার দলিল ব্যবসায়ীদের মধ্যে হাতবদল হওয়ার কারণে বাজারে আলুর দাম বাড়ছে। এ জন্য আলু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটকে দায়ী করছেন তাঁরা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মুন্সিগঞ্জের হিমাগারগুলোয় চাহিদার তুলনায় আলুর মজুদ অনেক বেশি রয়েছে। ব্যবসায়ীরা আলুর কৃত্রিম সংকট তৈরি করছেন। তাঁরা দাম বাড়িয়ে নিজেরাই হিমাগারে রাখা আলুর দলিল একজন অন্যজনের কাছে বেচাকেনা করছেন। হাতবদলে প্রতিবার বাড়ানো হচ্ছে দাম, যার প্রভাব পড়েছে পাইকারি ও খুচরা বাজারে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলায় এ বছর ভোক্তাদের মোট আলুর চাহিদা রয়েছে ৯৫ হাজার ৮৮ টন। সেখানে উৎপাদিত হয়েছে ১০ লাখ ৫৬ হাজার ৪৬৩ টন। জেলার হিমাগারগুলোয় গত মঙ্গলবার পর্যন্ত মজুদ ছিল ২ লাখ ৬৯ হাজার ২৩২ টন আলু। জাতীয় পর্যায়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে আলুর উৎপাদন ছিল ১ কোটি ১১ লাখ ৯১ হাজার ৫০০ টন। দেশে আলুর চাহিদা ৮৯ লাখ ৯২ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৯১ লাখ ৯ হাজার টন। সে হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকে ২০ লাখ টনের বেশি আলু।

জেলা কৃষি বিপণন কর্মকর্তা এ বি এম মিজানুল হক প্রথম আলোকে বলেন, গত বছর আলুর উৎপাদন সামান্য কম হয়েছে। তবে মুন্সিগঞ্জে আলুর কোনো সংকট নেই। এখনো যে পরিমাণ আলু হিমাগারে মজুদ আছে, তা চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি। জাতীয় পর্যায়েও একই অবস্থা। পুরোনো আলু শেষ হওয়ার আগে নতুন আলু চলে আসবে। আলু ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে বাজারে অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরি করেছেন।

গত বুধবার মুন্সিগঞ্জের বড়বাজার, দেওভোগ বাজারের সবজির দোকানগুলোয় ঘুরে দেখা যায়, প্রতি কেজি আলুর দাম গড়পড়তা ৪০ টাকা। ইকবাল হোসেন নামের এক ক্রেতা বলেন, একমাত্র আলুই ছিল গরিব ও মধ্যবিত্তের প্রধান সবজি। সেটিও সিন্ডিকেট করে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। ১৮-২০ টাকার আলু ৪৫ টাকায় কিনতে হচ্ছে। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি চলতে থাকলে সাধারণ মানুষকে না খেয়ে মরতে হবে।

আলু বস্তায় ভরে ওজন করা হচ্ছে। এর পরে পাঠানো হবে দেশের বিভিন্ন আরদে। মঙ্গলবার দুপুরে মুন্সিগঞ্জের সদর উপজেলার রিভারভিউ কোল্ড স্টোরেজে
ছবি: প্রথম আলো

খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, কয়েক দিন ধরে হিমাগারগুলোয় আলুর সংকট দেখাচ্ছেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। ২ সপ্তাহ আগে তাঁরা যে আলু ৩০-৩২ টাকা কেজি বিক্রি করেছেন, সে আলু ২ দিন ধরে ৩৫–৩৭ টাকায় কিনতে হচ্ছে। এর সঙ্গে অন্যান্য খরচ রয়েছে আরও এক থেকে দেড় টাকা। তাই বাধ্য হয়ে ৪০-৪৫ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি করতে হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মুন্সিগঞ্জে ৬২টি হিমাগার রয়েছে। যেখানে প্রতিবছর ৫ লাখ ৪৫ হাজার ৪৬০ টন আলু রাখা যায়। মুন্সিগঞ্জের স্থানীয় আলুর পাশাপাশি রংপুর থেকেও আলু এনে এসব হিমাগারে রাখা হয়। এসব আলু ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, সিলেট, বরিশাল, বরগুনা, চট্টগ্রামের বিভিন্ন আড়তে বিক্রি হয়। মৌসুমের শুরুতে হিমাগারগুলোয় ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি কৃষকেরা আলু রাখলেও জুলাইয়ের আগে কৃষকদের এসব আলু কিনে নেন ব্যবসায়ীরা। এরপরই আলুর বাজার ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।

গত সোম ও মঙ্গলবার সরেজমিনে টঙ্গিবাড়ী উপজেলার সানোয়ারা কোল্ডস্টোরেজ, নুর কোল্ডস্টোরেজ, সদর উপজেলার বিক্রমপুর মাল্টিপারপাস ও রিভারভিউ কোল্ডস্টোরেজে দেখা যায়, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে অন্য ব্যবসায়ীরা দরদাম করে আলু কিনছেন। শ্রমিকেরা বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে কেউ আলু বাছাই করছেন, কেউ আলু বস্তা ভর্তি করছেন, কেউ আলু ওজন করে বিভিন্ন জেলায়, আড়তে পাঠাতে ট্রাকে আলু তুলছেন।

এ সময় হিমাগারে কয়েকজন শ্রমিক বলেন, বছরের এ সময় হিমাগারে ব্যস্ততা এমনই থাকে। আলুর বিক্রির পরিমাণ গত বছরের মতোই। তবে দাম খুব চওড়া। এক সপ্তাহে কেজিতে দাম বেড়েছে ৮–১০ টাকা। কেন বেড়েছে জানতে চাইলে শ্রমিকেরা কোনো কথা বলতে চাননি।

আলুর দাম নিয়ে কথা বলতে নারাজ ব্যবসায়ীরাও; বরং অন্যান্য জিনিসের দামের সঙ্গে আলুর এমন দাম যৌক্তিক বলে মনে করছেন তাঁরা। আলু ব্যবসায়ী হাজী সৈয়দ দেওয়ান বলেন, দেশে সব তরকারির দাম আকাশছোঁয়া। অন্য তরকারির উৎপাদন নেই। এ ছাড়া এ বছর আলুর উৎপাদনও কম হয়েছে। তাই চাহিদা বেড়েছে। এতে আলুর দাম এবার সামান্য বেড়েছে। আহামরি বাড়েনি।

অথচ গত দুই বছর (২০২১ ও ২০২২) আলুতে লোকসান গুনতে হয়েছিলে উল্লেখ করে রিভারভিউ কোল্ডস্টোরেজের ব্যবস্থাপক মো. রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ৫০ কেজির এক বস্তা আলু ৬০০ টাকায় কিনেছিলেন ব্যবসায়ীরা। আলু কিনে হিমাগার পর্যন্ত আনতে প্রতি বস্তায় খরচ হয় আরও ১৪০ টাকা। এর সঙ্গে ২৪০ টাকা ছিল হিমাগারভাড়া। এতে এক বস্তা আলুর দাম পড়েছিল ৯৮০ টাকার মতো। কেজি হিসেবে দাম পড়েছিল ১৯ টাকা ৬০ পয়সা। আলুর দাম এতটাই কম ছিল, এক বস্তা আলু বিক্রি করে হিমাগারের ভাড়াও ওঠাতে পারেননি অনেকে।

এবার আলুর দাম বাড়ার পেছনে সিন্ডিকেটের বিষয়টি স্বীকার করেছেন ব্যবসায়ী শ্যামল সরকার। তিনি বলেন, ‘হিমাগারগুলোয় প্রতিদিন যেমন শত শত বস্তা আলু বিক্রি হচ্ছে, তেমনি আলুর মালিকানার দলিল বিক্রি হচ্ছে। এসব দলিল আমাদের মতো ব্যবসায়ীরাই একজন আরেকজনের কাছ থেকে কিনছেন। এমনও হয়েছে ২ মাস আগে ৫০ কেজির বস্তার যে দলিল ১ হাজার ৩০০ টাকায় বিক্রি করেছিলাম, সেই দলিল ১ হাজার ৪০০ থেকে দেড় হাজার টাকায় কিনেছি। ১৫ দিন ধরে একই দলিল ১ হাজার ৬০০ থেকে ১ হাজার ৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতিবার হাতবদল হলেই ৫০-১০০ টাকা দাম বাড়ছে।’

প্রায় একই কথা বললেন আরেক আলু ব্যবসায়ী মো. নাসির উদ্দিন। তিনি বলেন, সবাই আলুর দলিল বিক্রি করেন না। হাতে গোনা কয়েকজন ব্যবসায়ী এ কাজ করছেন।

এ বিষয়ে মুন্সিগঞ্জ ভোক্তা অধিকারের সহকারী পরিচালক আবদুস সালামের মুঠোফোনে কল করা হলে তিনি ধরেননি। তবে জেলা কৃষি বিপণন কর্মকর্তা এ বি এম মিজানুল হক বলেন, আলুর বাজার নিয়ন্ত্রণে ইতিমধ্যে ভোক্তা অধিকারসহ তাঁরা কাজ শুরু করেছেন। বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীকে জরিমানার আওতায় আনা হয়েছে।