ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্তির পরও অস্থিরতা, নেপথ্যে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের দুই নেতাকে মারধরের প্রতিবাদ সড়ক অবরোধ করেছেন সংগঠনটির বিলুপ্ত কমিটির নেতাকর্মীরা। বুধবার বিকেলে মহাসড়কের বেলতলী এলাকা
ছবি: প্রথম আলো

কমিটি বিলুপ্তির পর আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগে আবারও অস্থিরতা বিরাজ করছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কার হওয়া দুই নেতাকে মারধর এবং এর জেরে মহাসড়ক অবরোধের মধ্য দিয়ে এই অস্থিরতা প্রকাশ্যে এসেছে। এসব ঘটনার নেপথ্যে শিক্ষক-রাজনীতির প্রভাবও রয়েছে বলে ক্যাম্পাস সূত্রে জানা গেছে।

গতকাল বুধবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়–সংলগ্ন সালমানপুর এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের দুই নেতা মারধরের শিকার হন। বহিরাগত এক তরুণের পক্ষ হয়ে প্রতিপক্ষের নেতা-কর্মীরা এ ঘটনা ঘটান বলে অভিযোগ। মারধরের শিকার দুজন হলে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. সালমান চৌধুরী ও ভাষাসৈনিক শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ এনায়েত উল্লাহ।

মারধরের প্রতিবাদে এই দুই নেতার পক্ষের নেতা-কর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনের সড়ক অবরোধ করেন। এর আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্র হলে প্রক্টরিয়াল বডির কর্তব্য পালনে বাধা, সহকারী প্রক্টরকে হেনস্তা এবং শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে গত মঙ্গলবার এনায়েত উল্লাহ ও সালমান চৌধুরীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়।

আরও পড়ুন

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০০৭ সালে শিক্ষা কার্যক্রম চালুর পর থেকে এ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্ররাজনীতিমুক্ত ছিল। ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর এখানে ছাত্রলীগ প্রকাশ্যে রাজনীতি শুরু করে। সংগঠনের কোন্দলে ২০১৬ সালের ৩১ জুলাই রাতে মো. খালিদ ছাইফুল্লাহ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। ২০১৭ সালের ২৮ মে সভাপতি পদে মো. ইলিয়াস মিয়া ও সাধারণ সম্পাদক পদে রেজাউল ইসলাম মাজেদের নাম অন্তর্ভুক্ত করে আংশিক কমিটি দেয় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ওই কমিটি দায়িত্বে থাকার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রেজা-ই-এলাহী ও তাঁর অনুসারীরা ক্যাম্পাসে ঢুকতে পারেননি। এরপর একতরফা ইলিয়াস মিয়া পুরো বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁর বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ে দরপত্র নিয়ন্ত্রণ, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ বাণিজ্য, সাংবাদিকদের নিপীড়ন ও মারধর, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের মারধর, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের হয়রানি, শিক্ষকের বাসায় হামলা, মাদক সেবন, র‌্যাবের হাতে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার, নতুন ক্যাম্পাসে ভূমি অধিগ্রহণের নামে প্রভাব বিস্তারসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী ইলিয়াস মিয়া টানা ১৫ বছর ক্যাম্পাসে আছেন।

আরও পড়ুন

নানা অপকর্মের অভিযোগ ওঠায় গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ১১টায় এ কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি আল নাহিয়ান খান ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ওই তথ্য জানানো হয়েছিল। এরপর গত ১ অক্টোবর বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রেজা-ই-এলাহীর অনুসারীরা কেন্দ্রীয় নেতাদের স্বাগত জানিয়ে মোটরসাইকেল মহড়া দিয়ে আনন্দমিছিল করেন। তবে চলে যাওয়ার পর ইলিয়াস মিয়ার অনুসারীরা ছেনি, রামদা ও হকিস্টিক নিয়ে ক্যাম্পাসে মহড়া দেন। এ সময় ক্যাম্পাসে গুলির আওয়াজ ও ককটেল বিস্ফোরণের শব্দে পুরো এলাকা প্রকম্পিত হয়।

শৃঙ্খলাহীনতা ও গঠনতন্ত্র পরিপন্থী কার্যকলাপের অভিযোগে গত সোমবার দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত করার ঘোষণা দেয় ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের বর্তমান সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

আরও পড়ুন

এরই মধ্যে সহকারী প্রক্টরকে লাঞ্ছিত করার অভিযোগে গত মঙ্গলবার ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. সালমান চৌধুরী ও ভাষাসৈনিক শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত হলের ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ এনায়েত উল্লাহকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। এই দুই নেতা ইলিয়াস মিয়ার অনুসারী।

ছাত্রলীগ সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগে দুটি পক্ষ রয়েছে। এক পক্ষে বিলুপ্ত কমিটির সভাপতি মো. ইলিয়াস মিয়া ও আরেক পক্ষে ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রেজা-ই-এলাহীর অনুসারীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি ছাত্র হল ইলিয়াসের অনুসারীদের দখলে। রেজা-ই-এলাহী এখন তাঁর অনুসারীদের নিয়ে হলে উঠতে চান। এ নিয়ে বিবদমান পক্ষ দুটির মধ্যে উত্তেজনা আছে। কমিটি বিলুপ্ত, দুই নেতাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কার করায় ইলিয়াসের অনুসারীরা ক্ষুব্ধ হন। অপর দিকে পদপ্রত্যাশী রেজা-ই-এলাহীর অনুসারীরা ক্যাম্পাসে ও হলে ফিরে আসছেন। এ নিয়েই পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়।

আরও পড়ুন

বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত পাঁচজন সাধারণ শিক্ষক দাবি করেন, বিলুপ্ত কমিটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি অংশ মদদ দিচ্ছে। তাদের ইন্ধনে সড়ক, মহাসড়ক অবরোধ করে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করা হচ্ছে। অন্যদিকে পদপ্রত্যাশী ছাত্রলীগের আরেক পক্ষকে মদদ দিচ্ছে শিক্ষকদের আরেকটি পক্ষ। এ অংশের শিক্ষকনেতাদের মো. ইলিয়াস মিয়া পদে থাকা অবস্থায় নানাভাবে হয়রানি করেন।

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রেজা-ই-এলাহী বলেন, ‘বিদায়ী কমিটির কিছু নেতার কারণে ছাত্রলীগের সাধারণ কর্মীরা হলে উঠতে পারত না। সর্বত্র একটা অরাজকতা ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এর থেকে পরিত্রাণ চায়। বুধবার ছাত্রলীগের দুই নেতাকে মারধরের ঘটনার পেছনে ছাত্রলীগের কেউ জড়িত নন।’

জানতে চাইলে মো. ইলিয়াস মিয়া বলেন, ‘কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ জবাই হয়ে গেছে। এখানে ছাত্রলীগ বলতে কিছু নেই। গত এক বছরে ছাত্রলীগ প্রশাসন থেকে কোনো ধরনের সুবিধা ও সম্মান পায়নি। ছাত্রলীগের কোনো কর্মীর চাকরি হয়নি। ছাত্রলীগকে কোনো অনুষ্ঠানে ডাকা হয় না। আমি ছয় মাস ধরে ক্যাম্পাসে অনিয়মিত। এখন আর হলে থাকি না। বাড়িতে থাকি। এক বছরে বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনা ছাড়া কোনো ঝামেলা হয়নি।’

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন