ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের কক্ষে তুমুল বাগ্বিতণ্ডা, হট্টগোল
কুষ্টিয়ায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কক্ষে প্রশাসনের বিভিন্ন পদে দায়িত্বরত শিক্ষক–কর্মকর্তা, ছাত্রদলের নেতা–কর্মী ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের মধ্যে তুমুল বাগ্বিতণ্ডা ও হট্টগোল হয়েছে। রেজিস্ট্রার পদসহ কয়েকটি পদে নতুন নিয়োগ দেওয়া নিয়ে আজ মঙ্গলবার বেলা একটার দিকে এ ঘটনা ঘটে বলে বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে।
এদিকে এই হট্টোগোলের কয়েকটি ভিডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। এ সময় ক্যাম্পাসে কর্মরত সাংবাদিকেরা উপাচার্যের কক্ষে প্রবেশ করতে গেলে তাঁদের বাধা দেওয়া হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানা গেছে, সহ–উপাচার্য এয়াকুব আলী ও ছাত্রদলের আহ্বায়ক শাহেদ আহম্মেদের নেতৃত্বাধীন একটি পক্ষ বিএনপিপন্থী এক কর্মকর্তাকে রেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়োগ দিতে তৎপরতা চালাচ্ছেন। অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্রশাসনের মাধ্যমে নিয়োগের দাবি জানিয়েছে। এ নিয়েই মূলত হট্টগোলের সৃষ্টি হয়েছে।
কয়েকজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে উপাচার্যের সভাকক্ষে প্রকৌশলী এবং পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের পরিচালকের (পিডি) সঙ্গে সভা করছিলেন উপাচার্য নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ। সভা চলাকালে ‘প্রশাসনিক ও দাপ্তরিক পদ থেকে ফ্যাসিস্টের দোসরদের অপসারণের দাবিতে’ কার্যালয়ের সামনে বিএনপিপন্থী কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শাখা ছাত্রদলের নেতা–কর্মীরা গিয়ে হট্টগোল শুরু করেন। পরে বেলা পৌনে একটার দিকে সহ–উপাচার্য এয়াকুব আলী কার্যালয় থেকে নিচে নেমে আসেন। কিছুক্ষণ পর তিনিসহ জিয়া পরিষদের সভাপতি ফারুকুজ্জামান খান ও সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম, শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক শাহেদ আহম্মেদ ও সদস্যসচিব মাসুদ রুমির নেতৃত্বে ছাত্রদলের নেতা–কর্মীরা উপাচার্যের কার্যালয়ে প্রবেশ করেন। রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগ দেওয়া নিয়ে তাঁদের মধ্যে হট্টগোলের সৃষ্টি হয়।
এ সময় সাংবাদিকেরা সেখানে প্রবেশ করলে ছাত্রদলের আহ্বায়ক শাহেদ আহম্মেদসহ অন্য কর্মীরা তাঁদের বের করে দেন। একপর্যায়ে উপাচার্যের কার্যালয়ে সহ–উপাচার্য ও প্রক্টরিয়াল বডির মধ্যে কথা–কাটাকাটি শুরু হয়। এ সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের কার্যালয়ে ঢোকার চেষ্টা করলে ছাত্রদলের কর্মীরা তাঁদের বাধা দেন বলে অভিযোগ ওঠে। পরে তাঁদের উপেক্ষা করে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতারা কার্যালয়ে প্রবেশ করেন। সেখানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক মুখলেসুর রহমান ও শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক শাহেদ আহম্মেদের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়।
প্রত্যক্ষদর্শী একাধিক শিক্ষার্থী জানান, হট্টগোলের একপর্যায়ে সহ–উপাচার্য এয়াকুব আলী প্রক্টর শাহিনুজ্জামানকে ‘জামায়াত’ বলে আখ্যা দিলে দুজনের মধ্যে উচ্চবাচ্য সৃষ্টি হয়। সেখানে তুমুল হট্টগোল হয়। ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া একাধিক ভিডিওতে দেখা যায়, উপাচার্য, সহ–উপাচার্য ও প্রক্টর উচ্চ স্বরে কথা বলছেন। তাঁদের নিবৃত করার চেষ্টা করছেন কয়েকজন শিক্ষক। ‘চোপ (চুপ), চোপ’ বলে একে অন্যকে জোরে বলতে দেখা যায়। কাউকে একাধিকবার ‘বেয়াদব’ বলতেও শোনা যায়।
একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, হট্টগোলের একপর্যায়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সমন্বয়ক মুখলেসুর রহমান উপাচার্যের টেবিল চাপড়ে বলতে থাকেন, ‘এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কার কী অপরাধ আমরা জানি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন যে সিদ্ধান্ত নেবে, সেই সিদ্ধান্তের বাইরে যদি কেউ কথা বলেন, কোনো কর্মকর্তা হোক, যে–ই হোক না কেন, আমি তাঁর গলা ছিঁড়ে...(বোঝা যায়নি) করব। যে কর্মকর্তারা এখন চিল্লাচিল্লি করছেন, আমি তাদের অবস্থান জানি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি এককভাবে আন্দোলন পরিচালনা করছি। সহযোগিতা নিয়ে চলতে চাই। কিন্তু কেউ যদি এই সহযোগিতার মনোভাবকে দুর্বলতা মনে করেন, তাঁর আমি গলা ছিঁড়ে ফেলব। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের সঙ্গে এ রকম দুঃসাহস দেখাতে পারে!’
এরপর উপাচার্য বলতে থাকেন, ‘এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য খুবই অপমানজনক ঘটনা। আমার ধারণা, এই রুমে এরকমভাবে চিৎকার এবং শাউটিং ইতিহাসে কোনো দিন হয় নাই। আমি সবাইকে শান্ত করার চেষ্টা করেছি। প্রশাসনের এই তিনজন সব সময় বলেছি, আমরা চুপ থাকি। আমরা সবার কথা শুনি, কাজ করি।’
সমন্বয়ক মুখলেসুর রহমানকে ফোন করা হলে তিনি ধরেননি। তবে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আগে দেখতাম নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ পদ ভাগাভাগি নিয়ে হট্টগোল, প্রশাসনকে চাপ প্রয়োগ করত। এখন ছাত্রদল একই পথে হাঁটছে। এ রকম অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি নতুন বাংলাদেশে মোটেই কাম্য নয়। আজকের এই ঘটনা চরম লজ্জাজনক। আমরা ঘটনায় জড়িত দোষী ব্যক্তিদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ৪৮ ঘণ্টা সময় দিয়েছি। এর মধ্যে বিচার না করলে শিক্ষার্থীরা অন্য ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে।’
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আনোয়ার পারভেজ বলেন, রেজিস্ট্রার পদে বিএনপিপন্থী একজন কর্মকর্তা নিয়োগের দাবি জানিয়ে আসছিলেন শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক শাহেদ আহম্মেদ ও সদস্যসচিব মাসুদ রুমি। কিন্তু প্রক্টর শাহিনুজ্জামান তাঁদের একজন কর্মকর্তার বিপরীতে কয়েকজনকে প্রস্তাব করার কথা বলে। প্রক্টর এ কথা কেন বললেন, এ জন্য ছাত্রদলের প্যাডে শাহিনুজ্জামানের পদত্যাগ দাবির সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা। এ সময় আনোয়ার পারভেজ ছাত্রদলের প্যাড ব্যবহার করতে নিষেধ করেন। এরপর ছাত্রদলের আহ্বায়ক ও সদস্যসচিব উপাচার্যের সঙ্গে কথা বলতে যান। এ সময় প্রক্টরের বিষয়ে কথা ওঠায় শাহেদ আহম্মেদ। তখন সহ–উপাচার্য এম এয়াকুব আলী প্রক্টরকে জামায়াত বলে সম্বোধন করলে হট্টগোল তৈরি হয়। আনোয়ার পারভেজ বলেন, ‘সাংবাদিকদের সঙ্গে নিজ দলের কর্মীদের চেয়েও খারাপ ব্যবহার করা হয়েছে। আমি এর তীব্র নিন্দা জানাই। আহ্বায়ক ও সদস্যসচিবের এমন আচরণের দায় ছাত্রদল নেবে না।’
শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক শাহেদ আহম্মেদকে একাধিকবার কল করলেও তিনি ধরেননি।
প্রক্টর অধ্যাপক শাহিনুজ্জামান বলেন, ‘আমাকে জামায়াত বলে সম্বোধনের বিষয়টি কোনোভাবেই মেনে নেওয়ার নয়। বিগত দিনে আমি কী করেছি তা সবাই জানেন।’
সহ–উপাচার্য এম এয়াকুব আলীর মোবাইলফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোনের লাইন কেটে দেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত সাংবাদিকদের তিনি বলেছেন, উপাচার্যের কার্যালয়ে এক জুনিয়র শিক্ষক তাঁর সঙ্গে খারাপ আচরণ করেছেন। উপাচার্য এর বিচার না করলে তিনি বিষয়টি অন্যভাবে দেখবেন।
উপাচার্য নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহর মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন ধরেননি।