‘ভালো ছেইলি আমার বাড়িত থিকি নিই গেল, তারপর কী হইল’
‘কিসি কী হইলি কিছুই বুলতি পারছিনি, ভালো ছেইলি আমার বাড়িত থিকি নিই গেল, তারপর কী হইল,’ বলে বিলাপ করে মূর্ছা যাচ্ছিলেন বিলকিচ খাতুন। আজ রোববার বেলা ১১টার দিকে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের মর্গের সামনে এমন পরিস্থিতি দেখা যায়। বিলকিচ খাতুন নিহত শিশু মুগ্ধ হোসাইনের নানি।
গতকাল শনিবার বিকেলে কুষ্টিয়া শহরের মঙ্গলবাড়িয়া এলাকার একটি ভাড়া বাসা থেকে রেজাউল করিম ওরফে মধু (৩৮) ও তাঁর ৭ বছর বয়সী ছেলে মুগ্ধ হোসাইনের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
নাতির স্মৃতি হাতড়ে বিলকিচ খাতুন বলেন, ‘মুগ্ধ বাড়ি থেকে যাওয়ার আগে বলছিল, “নানি, আমি স্কুলে ভর্তি হব, তুমি গার্ড দিবা।” বেতন কত দিবা, বলেছিলাম। মুগ্ধ বলছিল, “পড়ালেখা করি চাকরি করব। ম্যালা টাকা হবি। সেই টাকা দিব।”’ এই বলে বিলকিচ আবার ডুকরে কেঁদে ওঠেন।
পুলিশের ধারণা, ছেলেকে হত্যার পর বাবা আত্মহত্যা করেছেন। লাশ দুটি উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়। এ ঘটনায় আজ সকালে মুগ্ধের মা শেফালি খাতুন বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা করেছেন। এ ছাড়া থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে।
কুষ্টিয়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সোহেল রানা প্রথম আলোকে বলেন, আজ সকালে দুটি পৃথক মামলা হয়েছে। একটি হত্যা মামলা, আরেকটি অপমৃত্যুর অভিযোগে মামলা। ছেলে মুগ্ধকে হত্যার অভিযোগে তাঁর মা শেফালী খাতুন বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা করেছেন।
ওসি সোহেল রানা আরও বলেন, ঘটনার পর থেকে পুলিশ ব্যাপক তদন্ত শুরু করেছে। আজ সকাল পর্যন্ত যা পাওয়া গেছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে, রেজাউল তাঁর ছেলের জন্মনিবন্ধন করতে পারছিলেন না। ছেলের জন্মনিবন্ধন করাতে না পেরে তিনি হতাশায় ভুগছিলেন। এ কারণেই ছেলেকে হত্যার পর তিনি আত্মহত্যা করেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে এলাকায় রেজাউল ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিত।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, রেজাউল করিম শহরের আলফা মোড় এলাকার বাসিন্দা। আট বছর আগে ধর্মান্তরিত হয়ে মিরপুর উপজেলার পোড়াদহ ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামের শেফালি খাতুনকে ভালোবেসে বিয়ে করেন। ধর্মান্তরিত হওয়ার আগে তাঁর নাম ছিল মধুসূদন রায়। রেজাউলের ছেলে মুগ্ধ হোসাইন। মঙ্গলবাড়িয়া এলাকায় রেজাউলের গয়না তৈরির ছোট একটি দোকান ছিল। সর্বশেষ তিনি এক বন্ধুর দোকানে কাজ করতেন।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে বিলকিচ খাতুন বলেন, মেয়ে শেফালি খাতুন অন্তঃসত্ত্বা হওয়ায় তাঁর বাড়িতেই ছিলেন। মেয়ের জামাতা খুবই ভালো মানুষ। তাঁর কাছে কেউ কোনো টাকাপয়সাও পায় না; বরং তিনি টাকা পেতে পারেন। গতকাল দুপুরে মুগ্ধকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হন রেজাউল। ছেলেকে স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করাবেন বলে স্ত্রীকে জানান। দীর্ঘক্ষণ পেরিয়ে গেলেও ছেলেকে নিয়ে ফিরে না আসায় শেফালি তাঁদের ভাড়া বাসায় যান। ঘরের দরজা বন্ধ দেখতে পেয়ে তিনি ডাকাডাকি করেন। এরপর সাড়াশব্দ না পেয়ে জানালার ছিদ্র দিয়ে স্বামী-সন্তানকে রশিতে ঝুলতে দেখেন। তখন তাঁর চিৎকারে প্রতিবেশীরা ছুটে আসেন। খবর পেয়ে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় বাবা-ছেলের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
ওসি শেখ সোহেল রানা বলেন, ‘রেজাউল জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন নিয়ে জটিলতায় পড়েছিলেন। এ জন্য ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করাতে পারেননি। এ নিয়ে ক্ষোভ ছিল। ঘটনাটি খুবই বেদনাদায়ক। এই ধরনের সমস্যা দ্রুত সমাধানের আওতায় আনা দরকার।’