ভূমধ্যসাগরে ট্রলারডুবি: ফরিদপুরের এক গ্রামের চার তরুণ নিখোঁজ, উৎকণ্ঠায় পরিবার

ট্রলারডুবির পর থেকে চার তরুণের খোঁজ না পাওয়ায় উৎকণ্ঠায় পরিবারের সদস্যরা। গতকাল বিকেলে ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেরার কৃষ্ণনগর গ্রামে
ছবি: আলীমুজ্জামান

অবৈধভাবে লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরে ট্রলারডুবির ঘটনার পর থেকে ফরিদপুরের চার তরুণের খোঁজ পাচ্ছে না তাঁদের পরিবার। ট্রলারে থাকা ফরিদপুরের দুই তরুণ জীবিত উদ্ধার হলেও বাকি চারজনের কী হয়েছে, তা জানা যায়নি। বর্তমানে তাঁদের পরিবারের সদস্যরা চরম উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে সময় পার করছেন।

নিখোঁজ চার তরুণের বাড়ি নগরকান্দা উপজেলার ডাঙ্গী ইউনিয়নের কৃষ্ণনগর গ্রামে। তাঁরা হলেন মোস্তফা মাতুব্বরের ছেলে আল আমিন মাতুব্বর (২০), সোবাহান মোল্লার ছেলে মাহফুজ মোল্লা (২২), এসকেন মোল্লার ছেলে নাজমুল মোল্লা (২৩) ও সেকেন ব্যাপারীর ছেলে আকরামুল ব্যাপারী (২৭)। তাঁরা স্থানীয় একটি দালাল চক্রের মাধ্যমে অবৈধভাবে ইতালি যাচ্ছিলেন।

দালাল চক্রের এক সদস্য কৃষ্ণনগর গ্রামের বাসিন্দা মুরাদ ফকির (৩৬) গত সোমবার ভোর সাড়ে চারটার দিকে নিখোঁজ আল আমিন মাতুব্বরের মা চামেলী বেগমকে ফোন করে নিখোঁজের তথ্য জানান।

এদিকে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, ভূমধ্যসাগরে ট্রলারডুবির ঘটনায় ১৭ বাংলাদেশিকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। লিবিয়া থেকে অবৈধ পথে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে তাঁরা ইতালি যাচ্ছিলেন। সোমবার ইতালি কর্তৃপক্ষ তাঁদের উদ্ধার করে উপকূলে নিয়েছে। ইতালির স্থানীয় সংবাদমাধ্যম এএনএসএর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উদ্ধার হওয়া ১৭ অভিবাসনপ্রত্যাশীর সবাই বাংলাদেশি নাগরিক। তাঁদের ইতালির সিসিলির শহর পোজালোতে রাখা হয়েছে। ইতালির কোস্টগার্ড জানিয়েছে, লিবিয়া থেকে ৩০ ব্যক্তিকে নিয়ে ইতালি অভিমুখে যাত্রা করা নৌকাটি গত রোববার বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে পড়ে এবং উল্টে যায়।

স্থানীয় একটি দালাল চক্রের মাধ্যমে অবৈধভাবে ইতালি যাচ্ছিলেন ওই তরুণেরা
ছবি: প্রথম আলো

ট্রলারডুবির ঘটনায় নিখোঁজ আল আমিন গত বছর এসএসসি পাস করেছেন। বিদেশে যাবেন বলে এরপর তিনি আর কলেজে ভর্তি হননি। তাঁকে পাঠাতে দালাল মুরাদ ফকিরকে আট লাখ টাকা দিয়েছিলেন মা চামেলী বেগম। তিনি বলেন, ওই নৌকায় মোট ৪৭ জন ছিলেন। এর মধ্যে ১৭ জন জীবিত উদ্ধার হয়েছেন। জীবিত উদ্ধার ব্যক্তিদের মধ্যে নগরকান্দার ডাঙ্গী ইউনিয়নের বিলগোবিন্দপুর গ্রামের নান্নু সররদারের ছেলে হৃদয় সরদার (২৫) ও আহমেদ ফরাজীর ছেলে রাসেল ফরাজী (২০) রয়েছেন।

চামেলী বেগম বলেন, ৯ মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে তাঁর ছেলের সঙ্গে সবশেষ কথা হয়। তখন ছেলে বলছিলেন ভালো আছেন। ওই দিন ভোর সাড়ে চারটার দিকে মুরাদ চামেলী বেগমকে ইমোতে জানান, তাঁদের ইতালির যাওয়ার জন্য নৌযানে উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মুরাদ ফকিরের সঙ্গে এ চক্রের আরও চার সদস্য আছেন। তাঁরা হলেন ডাঙ্গী ইউনিয়নের মশাউজান গ্রামের ফরহাদ ফকির, বিলগোবিন্দপুর গ্রামের লিটন সরদার ও আবুল হোসেন এবং বাসাগাড়ি এলাকার কাদের মাতুব্বর। চক্রটি তরুণদের ইতালি পাঠানোর কথা বলে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। টাকা নেওয়ার সময় লিবিয়া থেকে ইতালিতে বড় জাহাজে করে পাঠানোর কথা বলা হলেও পাঠানো হয় ট্রলারে। মুরাদ ফকির লিবিয়া থাকেন। কিছুদিন আগে তিনি দেশে এসেছিলেন। ১৫ দিন আগে আবার লিবিয়া চলে যান।

আরও পড়ুন

ডাঙ্গী ইউনিয়নের বিলগোবিন্দপুর গ্রামের আহমেদ ফরাজী বলেন, তাঁর ছেলে রাসেল গতকাল মঙ্গলবার বেলা আড়াইটার দিকে বিদেশি একটি সাহায্যকারী প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় ফোন করেছিলেন। ট্রলারডুবির ঘটনায় রাসেল ও হৃদয় সরদারকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানা গেছে। অন্যদের কী হয়েছে, তা তিনি জানেন না।

নিখোঁজ তরুণদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ৫ জানুয়ারি ওই সব তরুণ ইতালির যাওয়ার জন্য ঢাকা যান। ঢাকা থেকে ৮ জানুয়ারি দুবাই যান। দুবাইয়ে চার দিন থাকার পর মিসর হয়ে ১২ জানুয়ারি নাগাদ তাঁরা লিবিয়া পৌঁছান। এরপর সোমবার ভোর চারটার দিকে মুরাদ সবাইকে দুর্ঘটনার বিষয়টি জানান।
ডাঙ্গী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান কাজী আবুল কালাম জানান, মুরাদ একজন মানব পাচারকারী। তিনি এ পর্যন্ত অন্তত ২০০ তরুণকে পাঠিয়েছেন। তিনি লোক পাঠিয়ে কয়েক কোটি টাকা আয় করেছেন। তাঁর অবস্থা রাতারাতি ফুলেফেঁপে উঠেছে। গ্রামে বড় ইমারতবিশিষ্ট বাড়ি করেছেন। এলাকায় তিনি ‘বিদেশে পাঠাইনা মুরাদ’ নামে পরিচিত।

আরও পড়ুন

নগরকান্দা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মিরাজ হোসেন বলেন, এসব বিষয়ে কেউ কোনো অভিযোগ দেয়নি। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হবে।

নগরকান্দা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মনিরুজ্জামান ডাঙ্গী ইউনিয়নের বিলগোবিন্দপুর গ্রামের বাসিন্দা। তিনি বলেন, তিনি শুনেছেন ইতালি যাওয়ার পথে ট্রলারডুবির ঘটনা ঘটেছে। এতে তাঁদের এলাকার বেশ কয়েকজন উদ্ধার হয়েছেন। আবার বেশ কয়েকজন নিখোঁজ।

আরও পড়ুন