কক্সবাজারে মৌসুমের প্রথম বৃষ্টিতে লবণের উৎপাদন বন্ধ, হতাশ চাষি
মৌসুমের প্রথম বৃষ্টিতে কক্সবাজার উপকূলের ৬৬ হাজার একর জমির লবণ উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। বৃষ্টিতে ভিজে নষ্ট হয়েছে কয়েক শ মণ লবণ। ক্ষতিগ্রস্ত মাঠগুলো লবণ উৎপাদন উপযোগী করতে সময় লাগবে আরও সাত থেকে আট দিন। তত দিনে অন্তত দেড় লাখ মেট্রিক টন লবণ উৎপাদন থেকে বঞ্চিত হবেন জেলার ৪৫ হাজার প্রান্তিক চাষি।
চাষিরা জানান, মার্চের ১৫ তারিখ থেকে দৈনিক ২২ হাজার মেট্রিক টন করে লবণ উৎপাদিত হচ্ছিল, যা চলতি মৌসুমের সর্বোচ্চ উৎপাদন। এমন ভরা মৌসুমে ঝোড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টির কারণে টানা সাত দিন লবণ উৎপাদন বন্ধ থাকলে চাষিরা আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হবেন। পাশাপাশি উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সংকট দেখা দিতে পারে।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) তথ্য অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে (১৫ নভেম্বর থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত পাঁচ মাস) কক্সবাজার সদর, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পেকুয়া, চকরিয়া, ঈদগাঁও, রামু ও বাঁশখালী উপজেলার ৬৬ হাজার ২৯১ একর জমিতে লবণ উৎপাদিত হচ্ছে। এসব জমিতে লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৩ লাখ ৮৫ হাজার মেট্রিক টন। ১৮ মার্চ পর্যন্ত ৪ মাসে লবণ উৎপাদিত হয়েছে ১২ লাখ ৬২ হাজার ৮৮১ মেট্রিক টন, যা গত বছরের এই সময়ের তুলনায় ৩ লাখ মেট্রিক টন বেশি। গত বছর এই সময় লবণ উৎপাদিত হয়েছিল ৯ লাখ ৬৯ হাজার ২৬৭ মেট্রিক টন।
বিসিক লবণ উন্নয়ন প্রকল্পের মাঠ পরিদর্শক মো. ইদ্রিস আলী গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, গত শুক্রবার থেকে কক্সবাজারের আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। তখন চাষিদের সতর্ক করা হয়েছিল। চাষিরা বৃষ্টির শঙ্কায় মাঠে স্তূপ করে রাখা লবণ মাটির নিচের গর্তে এবং গুদামে সরিয়ে রাখেন। এ কারণে গতকাল ভোর থেকে শুরু হওয়া বৃষ্টিতে লবণের তেমন ক্ষতি হয়নি। তবে বৃষ্টির পানিতে জেলার ৬৬ হাজার একরের বেশি লবণ উৎপাদনের মাঠ ডুবে গেছে। এ কারণে লবণের উৎপাদন বন্ধ আছে। এসব মাঠ উৎপাদন উপযোগী করতে অন্তত আরও সাত দিন সময় লাগবে। মাঠে সমুদ্রের লোনাপানি জমিয়ে সূর্যতাপে শুকিয়ে তৈরি হয় লবণ। মাঠে মিষ্টিপানি (বৃষ্টির পানি) জমে থাকলে সহজে লবণ জমে না।
বিসিক কর্মকর্তারা বলেন, সবশেষ ১৭ মার্চ ১ দিনে জেলার ৬৬ হাজার একর জমিতে ২২ হাজার ৩০০ মেট্রিক টন লবণ উৎপাদিত হয়েছিল, যা মৌসুমের সর্বোচ্চ উৎপাদন। এর আগে দৈনিক ১২ হাজার থেকে ২২ হাজার মেট্রিক টন লবণ উৎপাদন হয়েছিল, যার বাজারমূল্য প্রায় ১৭০ কোটি টাকা। বৃষ্টির কারণে ৭ দিন লবণ উৎপাদন বন্ধ থাকলে ৪৫ হাজারের বেশি চাষি অন্তত ১ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন লবণ উৎপাদন থেকে বঞ্চিত হবেন।
সাগরদ্বীপ মহেশখালী উপজেলার কালারমারছড়া ইউনিয়নের উত্তর নলবিলাতে প্রায় ২৫০ একর জমিতে লবণ চাষ করছেন স্থানীয় বাসিন্দা হাসানুল আবেদীন। গতকালের বৃষ্টিতে পুরো মাঠের লবণ উৎপাদন বন্ধ হয়েছে জানিয়ে হাসানুল আবেদীন প্রথম আলোকে বলেন, বৃষ্টি হবে জেনে চাষিরা মাঠে উৎপাদিত লবণ আগেভাগে সরিয়ে রেখেছেন। এ কারণে খুব বেশি লবণ নষ্ট হয়নি। তবে ক্ষতিগ্রস্ত মাঠগুলো উৎপাদন উপযোগী করতে আরও অন্তত সাত থেকে আট দিন সময় লাগবে। তত দিন ৩০ থেকে ৪০ জন শ্রমিক অর্থসংকটে পড়বেন।
জেলার টেকনাফ, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, চকরিয়া, ঈদগাঁও, রামু ও কক্সবাজার সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকার মাঠেও লবণ উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। চাষিরা জানান, গতকাল ভোর চারটার দিকে ভারী বৃষ্টি শুরু হয়, সঙ্গে দমকা ও ঝোড়ো হাওয়া বইতে থাকে। বিকেল চারটা পর্যন্ত জেলার বিভিন্ন উপকূলে থেমে থেমে বৃষ্টি ও ঝোড়ো হাওয়া বইতে থাকে। আকাশ ছিল মেঘাচ্ছন্ন। সারা দিন সূর্যের মুখ দেখা যায়নি। আজ মঙ্গলবারও উপকূলজুড়ে বৃষ্টি হতে পারে।
কুতুবদিয়ার লেমশিখালী ইউনিয়নের প্রায় দুই হাজার একর জমিতে গত রোববারও কয়েক শ মেট্রিক টন লবণ উৎপাদন হয়েছে। গতকাল সকাল থেকে মাঠে বিছানো পলিথিনগুলো তুলে নেওয়া হচ্ছিল। বৃষ্টি বন্ধ হলে সূর্যের প্রখর তাপ বিরাজ করলে তবেই চাষিরা মাঠে নামবেন।
উপজেলার আলীআকবর ডেইল গ্রামের চাষি মিনহাজ উদ্দিন মাঠের একপাশের বড় একটি মাটির গর্তে ফেলেন কয়েক হাজার মেট্রিক টন লবণ। তারপর মাটি দিয়ে লবণ চাপা দিয়ে রাখেন। কারণ জানতে চাইলে মিনহাজ উদ্দিন (৪৫) বলেন, এলাকাতে উৎপাদিত লবণ সংরক্ষণের সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে গুদামঘর নেই। দুর্যোগে চাষিরা মজুত লবণ মাটির গর্তে কিংবা বাড়িতে সংরক্ষণ করেন। বেশির ভাগ লবণ সংরক্ষণ করা হয় মাটির নিচের গর্তে। গর্তে লবণ নিরাপদ থাকে। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে ঘরবাড়িসহ গাছপালা লন্ডভন্ড হলেও মাটির নিচে রাখা লবণের হেরফের হয় না।
মহেশখালীর কালারমারছড়া, ধলঘাটা, কুতুবজোম ইউনিয়নেও শত শত মেট্রিক টন লবণ মাটির নিচের গর্তে চাপা দেওয়া হয়েছে। কুতুবজোম ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান শেখ কামাল প্রথম আলোকে বলেন, সারা দিনের বৃষ্টিতে ইউনিয়নে ৩০ থেকে ৪০ জন চাষির কয়েক শ মণ লবণ নষ্ট হয়েছে। তবে অধিকাংশ চাষির লবণ আগেভাগেই সংরক্ষণ করা হয়েছে।
লবণের দাম নিয়ে হতাশ চাষিরা
কুতুবদিয়ার লেমশিখালীর চাষি মামুনুল ইসলাম বলেন, ১৭ মার্চ তিনি প্রতি মণ লবণ বিক্রি করেছেন ৩৭০ টাকায়। এর আগের কয়েক দিন বিক্রি করেন ৩৮০ টাকায়। বৃষ্টির কারণে মাঠে লবণ উৎপাদন বন্ধ হওয়ায় উৎপাদিত লবণের দামও মণপ্রতি ৩০ থেকে ৪০ টাকা বেড়ে গেছে। চাষিরাও সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রতি মণ লবণের দাম ৪০০ টাকা হাঁকছেন। তবে সরকার চাইলে মাঠপর্যায়ে প্রতি মণ লবণের দাম ৪৫০ টাকা নির্ধারণ করে দিতে পারে বলে মন্তব্য করেন এই চাষি।
লবণের ব্যবসা সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে জানিয়ে মহেশখালীর লবণচাষি ও কক্সবাজার-২ (মহেশখালী-কুতুবদিয়া) আসনের সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক বলেন, চাষিদের দাবি মাঠপর্যায়ে প্রতি মণ লবণের দাম মৌসুমজুড়ে ৪০০ টাকার বেশি থাকুক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদেশ থেকে লবণ আমদানি বন্ধ রেখে মাঠপর্যায়ে চাষিদের সর্বোচ্চ ৫০০ টাকায় লবণ বেচাবিক্রির সুযোগ করে দিয়েছিলেন। ফেব্রুয়ারিতে ৫০০ টাকায় লবণ বেচাবিক্রিও হয়েছিল। পরবর্তী সময় সিন্ডিকেট চক্র দাম ২৫০ টাকা কমিয়ে চাষিদের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে।
বিসিকের তথ্য মতে, প্রায় ৪৫ হাজার প্রান্তিক চাষি, ১ লাখ শ্রমিকসহ জেলার অন্তত ১০ লাখ মানুষ লবণ উৎপাদন, বিপণন, পরিবহন ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।
চাষিদের অভিযোগ, এখন ঢাকা, নারায়ণগঞ্জে প্রতি মণ (অপরিশোধিত) লবণ ৭২০ টাকায় বেচাবিক্রি হলেও কক্সবাজারের মাঠে ৩৭০ টাকা। মধ্যখানে ৩৫০ টাকার ভাগ কোথায় যাচ্ছে, তা অনুসন্ধানের কেউ নেই।