খালেদা জিয়া চট্টগ্রামকে ভালোবাসতেন, ছুটে আসতেন যেকোনো দুর্যোগে
বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রাম থেকে যতবারই নির্বাচন করেছেন, ততবারই বিজয়ী হয়েছেন। তিনি চট্টগ্রামকে ভালোবাসতেন। যেকোনো দুর্যোগে ছুটে আসতেন চট্টগ্রামবাসীর কাছে।
শেষ ২০১৭ সালে চট্টগ্রামে এসেছিলেন খালেদা জিয়া। তাঁকে হারিয়ে শোকে স্তব্ধ চট্টগ্রাম বিএনপির নেতা–কর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ। নগর বিএনপির সদস্যসচিব নাজিমুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, প্রিয় নেত্রীকে একনজর দেখা ও জানাজায় অংশ নেওয়ার জন্য অনেকে ছুটছেন ঢাকার উদ্দেশে।
গতকাল সোমবার চট্টগ্রামে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম–১১ (বন্দর–পতেঙ্গা) আসনে মনোনয়নপত্র জমা দেন। আজ মঙ্গলবার সকালে খালেদা জিয়ার মৃত্যুর খবর শোনেন। পরে সকালেই বিমানযোগে ঢাকায় চলে যান।
২০০৯ সালের পর থেকে আন্দোলন–সংগ্রামে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে অংশ নিয়েছিলেন আমীর খসরু। তিনি আজ সকালে প্রথম আলোকে বলেন, ‘দীর্ঘ ১৭ বছর আমাদের আন্দোলনে নেতৃত্ব থেকে শুরু করে সাহস জুগিয়েছেন খালেদা জিয়া। শেষের দিকে অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান আমাদের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। এত বাধা–বিপত্তির মধ্যেও কখনো পিছপা হননি। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার দেশ ছাড়তে বাধ্য করলেও দেশের মানুষকে ছেড়ে যাননি। নিজে কারাগারে গেছেন। সেখানে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তারপরও দেশের মানুষের স্বার্থে গণতন্ত্রের জন্য কাজ করে গেছেন। নিজের ভালোর জন্য কখনো কোনো সমঝোতায় আসেননি। সব সময় দেশ ও গণতন্ত্র নিয়ে ভেবেছেন। মানুষের ভোটাধিকারের জন্য লড়ে গেছেন।’
চট্টগ্রামের উন্নয়নেও খালেদা জিয়ার অবদান রয়েছে বলে জানান আমীর খসরু। তিনি বলেন, ‘আজ আমি চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফ্লাইটে ওঠার জন্য অপেক্ষায় আছি। এটিও চট্টগ্রামবাসীকে উপহার দিয়েছেন খালেদা জিয়া। কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতু, ইপিজেড, কেইপিজেডসহ সবকিছু তাঁর অবদান।’
সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া আজ সকাল ছয়টায় রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। আগামীকাল বুধবার বেলা দুইটায় জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজা ও এর সংলগ্ন মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। তাঁকে তাঁর স্বামী সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের পাশে দাফন করা হবে। গত ২৩ নভেম্বর খালেদা জিয়াকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। এক মাসের কিছু বেশি সময় তিনি সেখানেই চিকিৎসাধীন ছিলেন। এবার তিনি আর চিকিৎসায় সাড়া দিতে পারলেন না। ‘দেশনেত্রী’ ও ‘আপসহীন’ উপাধিতে ভূষিত খালেদা জিয়া চিরবিদায় নিলেন তাঁর প্রিয় দেশবাসীর কাছ থেকে।
১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খালেদা জিয়া চট্টগ্রাম–৮ ও ১৯৯৬ সালের জুনে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম–১ আসন থেকে নির্বাচন করে জয়ী হন।
শেষ চট্টগ্রামে এসেছিলেন ২০১৭ সালে
বিএনপির নেতা–কর্মীরা বলেন, স্বামী প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সঙ্গে চট্টগ্রামে আসতেন। এরপর নিজে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেত্রী থাকাকালে কখনো দুর্যোগে আবার কখনো রাজনৈতিক সমাবেশে ছুটে আসতেন এখানে। চট্টগ্রামবাসীর নানা সমস্যার সমাধানের পথ দেখাতেন।
২০১৭ সালের ২৮ অক্টোবর কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে যাওয়ার পথে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে রাত যাপন করেন খালেদা জিয়া। ওই সময় বিএনপির নেতা–কর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করেন। আসার পথে খালেদা জিয়ার গাড়িবহর কয়েকটি স্থানে হামলার শিকার হয়। এতে দলের কয়েকজন নেতা–কর্মী ও গণমাধ্যমকর্মী আহত হয়েছেন। বহরে থাকা কয়েকটি গাড়িও ভাঙচুর করা হয়।
নগর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম সার্কিট হাউসের সেই বৈঠকে ছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘তখন আওয়ামী লীগ সরকার আমাদের নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে একের পর এক গায়েবি মামলা দিয়ে যাচ্ছিল। কারাভোগও করেছি আমরা। কিন্তু খালেদা জিয়ার বক্তব্যে নেতা–কর্মীরা নতুন করে সাহস পেয়েছেন। তাঁর কথায় আন্দোলন–সংগ্রামে, বিশেষ করে গণতন্ত্রের জন্য রাজপথে থাকতে পেরেছেন। আওয়ামী লীগের পতন হয়েছে।’
দুর্যোগে চট্টগ্রামবাসীর পাশে
২০১২ সালের ১ জুলাই চট্টগ্রামের খুলশীর আকবর শাহ মাজার–সংলগ্ন ইয়াছিন কলোনিতে ধসে পড়া পাহাড় পরিদর্শন করে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করেছেন তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা খালেদা জিয়া। ওই বছরের ২৬ জুন অতিবর্ষণে পাহাড় ধসে ওই পাহাড়ের পাদদেশে একই পরিবারের তিনজনসহ সাতজন নিহত হন।
ওই সময় নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন বর্তমান সিটি মেয়র শাহাদাত হোসেন। সেই দিনের স্মৃতিচারণা করে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের হাতে খালেদা জিয়া নিজেই ত্রাণ তুলে দেন।
মেয়র বলেন, একই বছরের ৯ জানুয়ারি চট্টগ্রামের পলোগ্রাউন্ড মাঠে ৪–দলীয় জোটের জনসভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়ে আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি দিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। তাঁর পরিচালনায় সেদিনের জনসভা জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছিল। এটি চট্টগ্রামে খালেদা জিয়ার শেষ বড় জনসভা।
১৯৯৭ সালের ভূমিকম্পে নগরের হামজারবাগের সওদাগর ভিলা ধসে ২৩ জনের মৃত্যু হয়। ঘটনার পর ছুটে আসেন খালেদা জিয়া। আহত ব্যক্তিদের দেখতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গেলে সেখানে তাঁকে লিফটে তিন ঘণ্টা আটকে রাখা হয়েছিল।
১৯৯৩ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিন শিক্ষার্থীকে খুনের পরও চট্টগ্রাম ছুটে এসেছিলেন খালেদা জিয়া।